‘এই বইটা সত্যিই অপরিহার্য’
ঝর্ণা মুখোপাধ্যায়
‘এই বইটা সত্যিই অপরিহার্য।’ প্রতিদিন বিজ্ঞাপন টিভি তে। সিলেক্টেড কতগুলো প্রশ্ন পড়ে উগরে দিতে পারলেই ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হবেই হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য মাথাব্যথা নেই। কিশোরদের চিন্তার জাল বিচ্ছিন্ন হচ্ছে ক্রমশ। কল্পনার জগতে কটা প্রশ্ন আর উত্তর। নেই খেলাধুলা, নেই প্রকৃতির ডালপালা নেই সৃজনশীল চিন্তা। আছে কেবল একাধিক মাষ্টারের কাছে স্কুলের পর যাওয়া আসা আর হাতে মোবাইল।
ছোট বেলার টুকরো টুকরো চিন্তা নিয়েই তো একটা সত্যিকারের মানুষ তৈরি হয়। এখন কিশোর কিশোরীরা বাবা মায়ের ইচ্ছের জালে মোড়া। যাদের ভেতরে নেই আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রকাশের ব্যাকুলতা, আর আবেগ। এই বয়সটাই যে জীবনের সন্ধিক্ষণ। শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত সময়ের অধিবাসী কিশোর বেলা। শারীরিক ও মানসিক ভাবে বেড়ে ওঠার সময়। এই সময়ে ওরা ব্যথা, যন্ত্রণা,ভয়, লজ্জা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওরা সব কিছুই জানে বলে মনে করে। বিরক্ত হয়, মুখে মুখে তর্ক করে। জীবনের গতিটাই সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। চাই একটা বন্ধু অর্থাৎ যথার্থ দোসর। অনুকূল পরিবেশ থাকলে, ছেলে মেয়েরা ঠিক পথেই হাঁটে। যদি তা না হয়, অন্যপথে অন্য মানসিকতার শিকার হয়।
আমাদের ভেতরে থাকে দুটো সত্ত্বা। একটা অন্তর মুখি আর একটা বার মুখি। নানান জটিলতা সৃষ্টি হয় কিশোর কিশোরীদের মধ্যে। ভেতরের কথা কাউকে বলবেনা। এইসব জটিলতা দূর হয়ে যায় যদি তারা খেলাধুলা, নানান ধরনের গান, বইপড়া, বাজনা, ব্যায়াম, ইত্যাদি নেশার মধ্যে ডুবে থাকে। তারা পাঁচজনার মধ্যে যদি থাকে, তবে নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় পায়না। কারণ গান বা বইপড়া স্থির ভাবে ভাবতে শেখায়। আবার খেলাধুলা, নানান সংস্কৃতি ক্রিয়া কর্মের মধ্যে থাকলে চিন্তা ভাবনার রসদ পায় দাদা দিদিদের কাছ থেকে, চিন্তাশীল এবং সৃষ্টিশীল ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
বতর্মানের মানুষেরা এক বিচ্ছিন্ন জগতের বাসিন্দা। মা, বাবা আর তাঁদের সন্তান। দুজনে কাজে গেলে হয়তো আয়া। বাইরের বাড়িতে কি হচ্ছে কেউ জানে না। মা বাবা তাঁদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের সন্তানের উপর। সবাই কে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে, কম নম্বর পেলে চলবে না, খেলাধুলা করা যাবে না। মাষ্টারের কাছে ছুটতে হবে গন্তব্যে পৌঁছাতে। মা বাবার অপরিহার্য বই প্রতিটি বিষয়ের মাষ্টার। অনেক টাকা রোজগার করতে পারবে। এটাই তাঁদের কাছে মানুষ হওয়ার মাপকাঠি। পাশের বাড়িতে প্রেসার মাপতে একজন ডাক্তারের পাঁচশ টাকা নিতে বুক কাঁপে না। এরা দেশের মানুষ না দেশের শত্রু? আমি তা বলতে পারব না।
জাপানিদের উন্নতির মূল কারণ রাজা প্রজা সকলেই দেশের কথা ভাবে। আমরা ভাবি আমাদের সম্পদ বাড়ানোর কথা। কিশোর জগৎ যদি নিজস্ব স্বাধীনতা ভোগ না করতে পারে, ভেতরের দুঃখের ভাবনায় অমানবিক মানসিকতার জন্ম নিতে বাধ্য।কেউ কেউ অবসাদে ভোগে,কেউ আবার অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। কিছু কিছু মদ, জুয়া, ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় তাদের ছেলে মেয়েরা শিশু শ্রমিক হয়,বা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত হয়ে পড়ে। তাদের স্কুল নেই, খাবার নেই, স্কুল তুলে দিচ্ছে সরকার।
আমরা আজ নৈরাজ্যের গভীরে। ধনের দিকে যতো নজর জ্ঞানের দিকে নেই। আমরা এই শিক্ষা দিই না, বড়ো হলে তোদের সমাজের জন্য ভাবতে হবে। তাদের মধ্যে যুক্তি তর্কের একটা বিজ্ঞান মনস্ক মানসিকতা ও গড়ে দেওয়া উচিত বলে ভাবি না। এ যুগের ভাঙনে তাই কৈশোর ও যৌবনের শব্দ শোনা যায় না।জাতির উত্থান পতনের কাহিনী লেখা হচ্ছে না।
শিক্ষিত হতে গেলে ভালো করে দেশের খবরাখবর নেওয়া, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান চেতনা,ও আদর্শের শিক্ষা অবশ্যই দরকার। মূল কথা মূল্যবোধ। শুধু প্রশ্নের কটা উত্তর মুখস্থ করে লিখে আসা আর পাস করা নয়, বা জয়েন্টে চান্স না পেলে টাকা দিয়ে পড়ানো নয়। সমাজের আবহাওয়ায় বড়ো না হতে দেওয়া থেকেই, দেশে হিংসা,জাতি বিদ্বেষ, কুসংস্কার ইত্যাদি রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে,একে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে যদি কিশোর জগতে ওদের স্বাধীনতাকে খর্ব না করা হয়। নাহলে দুর্বলের উপর সবলের চাপ বাড়তে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলা যায়,
“উঠিয়া দাঁড়াও আপন আলোতে,/ওই চেয়ে দেখো কতদূর হতে/তোমার কাছে ধরা দিবে বলে/আসে লোক কতশত।”