অনন্য কথা
ড. প্রিয়াঙ্কা দেবনাথ
(১)
‘তুমি তো হলে সাহেব মানুষ। হাত দিয়ে ভাত তরকারি মাখো না। কাঁটা চামচে খাও। এরকম খেলে কি আর শরীরে সে খাবার লাগে! ‘ছোটদাদু সুযোগ পেলেই দীপেনকে এই কথা টা শুনিয়ে মজা করে খোঁচা দেন। আজও বিকেলে ঝোলা গুঁড় দিয়ে রুটি খেতে খেতে ছোটদাদু দীপেনকে সে কথাটা বললেন। বেচারা দীপেন! তখন সবে সে স্কুল থেকে ফিরেছে। মুখ হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে ছোটদাদুর উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসে কাঁটা দিয়ে চাউমিন খাচ্ছে!
ছোটদাদু। অনন্যময় দত্তগুপ্ত। দীপেনের বাবার ছোটকাকা ইনি। আসলে একসময়ে কুস্তি লড়াইয়ে খুব নাম করেছিলেন ছোটদাদু।
আর ইংরেজিতেও খুব চৌকস ছিলেন বলে সরকারি স্কুলের চাকরিও পেয়েছিলেন সেসময়ে। দীপেনদের এই আদি বাড়ি “নিকুঞ্জধাম” -এ একসাথেই থাকেন এই অকৃতদার ছোটদাদু।
শরীরচর্চার ব্যাপারে এখনো ছোটদাদু বাড়ির মধ্যে ফার্স্ট। সময় মতো ঘুম থেকে উঠে জামা প্যান্ট আর স্যু পরে মর্নিং ওয়াকে যান। এসে খালিপেটে একগ্লাস জল খান। তারপর দু’মুঠো কাঁচা বাদাম আর কল ওঠা ছোলা। আর গাছের পাকা পেঁপে। কিম্বা গোটা চারেক কাঁটালি কলা। এর বাইরে দাঁতে কিচ্ছু কাঁটবেন না। দুপুরে রুটি ডাল সবজি। রাতেও তাই। সাথে একবাটি দুধ। সব ব্যাপারেই সংযত। তা সে খাবার দাবার হোক বা পোশাক আশাক ই হোক। কিম্বা কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাপারই হোক। তবে পরিবারের সবার ভীষণ প্রিয় এই অন্য দাদু।
(২)
‘দীপু রে ! দাবার বোর্ডখানা নিয়ে বারান্দায় চলে আয়। বেশ রোদ এখানে’ - ছোটদাদু জানলা দিয়ে দীপেনকে ডাকলেন রোববার দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর। ছোটদাদুর মতো সঙ্গী জুটেছে বলে খুনসুটি মজায় দীপুর সময় দিব্যি হৈ হৈ করে কেটে যায়।
এসময়ের ছেলেমেয়েগুলো কি যে মোবাইল এ টাকুস টুকুস করে সময় কাটায় অনন্যময় বোঝেন না। হাত পা না চালালে ছোট ছোট হাড়ে এইটুকু বয়সেই যে জং ধরে যাবে। সে নিয়ে সবাইকে সুযোগ পেলে সতর্কও করেন। তাঁর এখন ঠিক নব্বই ছুঁতে মাস তিনেক বাকি। তবে আজ অবধি দিব্যি দু’পায়েতেই শিরদাঁড়া সোজা করে চলাফেরা করেন। লাঠি কিছুতেই হাতে নেবেন না। মজা করে বলেন - ‘বাচ্চা বেলায় চারপায়ে হামা টেনেছি । তারপর এই দু পায়ে প্রমোশন হলো। এরপর তোমরাই বলো আর তিন-পায়ে ডিমোশন হলে চলবে কেন!’
(৩)
দীপেনদের বাড়িতে আজ সকাল থেকেই সব আত্মীয়স্বজন, লোকজন, বড়দাদু - ছোটদাদুর পরিচিতজনরা আসছেন। সকলেরই হাতে ফুল কিম্বা ফুলের স্তবক। সকলেই আসছেন শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে। আজ অনন্যময়ের নব্বই তম জন্মবার্ষিকী।
অবশ্য যাঁকে ঘিরে বাড়িময় এই উৎসব আবহ, সেই ছোটদাদু এসব আড়ম্বরের আড়ালে। গতকাল বাবা, ছোটকাকা আর এডভোকেট অমলদীপ কাকুর উপস্থিতিতে নিজের সব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি স্থানীয় গার্লস স্কুলকে দান করে উইল করেছেন। তবে নিজের সংগ্রহের বিশাল বড় দুই আলমারির দুর্লভ বই এর দায়িত্ব দিয়েছেন দীপুকেই।
আজ নিজের ঘরে দীপেনকে বলে সকাল থেকেই একখানা রেকর্ড চালিয়ে নিয়েছেন একান্তে। সরোদে বাজছে প্রিয় শ্রী রাগের বন্দিশ। আয়নায় তো বাইরের মুখচ্ছবিটাই শুধু ধরা পড়ে। ভেতরটা দেখতে গেলে নিজের সাথে মুখোমুখি না বসলে কি চলে! অনন্যময় নিভৃতে তাই মুখোমুখি। নিজের সাথে।