ভূতের বটগাছ 

তনুষ্কা দে

গঙ্গার ধারে শান্তশিষ্ট গ্রাম শিবপুর। চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত, সরু মাটির রাস্তা, আর মাঝখানে একটা পুরনো বটগাছ—বছরের পর বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই গাছ নিয়ে গ্রামে প্রচলিত আছে এক অদ্ভুত কাহিনি।

বৃদ্ধ মহেশ দাদু বলেন, “বাবা, সন্ধ্যার পর ওই গাছের কাছে যাস না! বহু বছর আগে, এক জমিদার এই গাছের নিচে এক গরিব মানুষকে মেরে পুঁতে দিয়েছিল। সেই থেকেই ওখানে ভূতের বসবাস।”

কেউ বলে গাছের ডালে সাদা কাপড়ে মোড়া ছায়া দেখা যায়, কেউ বলে রাতে কান্নার আওয়াজ আসে, আবার কেউ বলে সেখানে গেলে মানুষ হারিয়ে যায়!

কিন্তু পনেরো বছরের নীলু এসব কথা বিশ্বাস করে না। তার মতে, সবটাই গাঁজাখুরি গল্প। সে সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেই গিয়ে রহস্য উদঘাটন করবে।

---

রহস্যের সন্ধানে 

সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। চারদিকে ফিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে ছিল। নীলু তার দুই বন্ধু রাজা আর তপনকে নিয়ে গোপনে বেরিয়ে পড়ল।

রাজা গলা নামিয়ে বলল, “নীলু, এটা কি সত্যিই দরকার?”

তপন     ফিসফিস  করে  বলল,  “তুই  কি  ভয় পেয়েছিস?”

রাজা গম্ভীর মুখে বলল, “আমি ভূতে বিশ্বাস করি না, কিন্তু গাছটার ব্যাপারে যা শোনা যায়…”

নীলু দৃঢ়ভাবে বলল, “ভয় পাস না। আসল সত্য জানতেই হবে।”

তারা তিনজন ধীরে ধীরে বটগাছের কাছে পৌঁছল। চারপাশে পাতা ঝরার মৃদু শব্দ, হাওয়া বইছে কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ যেন নিঃশ্বাস ফেলছে গাছের ভেতর থেকে!

তপন ফিসফিস করে বলল, “শুনলি? আমি তো বলেছিলাম এটা ভালো বুদ্ধি নয়!”

রাজা বলল, “ওটা বাতাসের শব্দ হতে পারে। চুপ করে থাক!”

অবশেষে, তারা গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ করেই, কোথা থেকে একটা মরা ডাল খসখস শব্দ করে ভেঙে পড়ল!

রাজা চিৎকার করে উঠল, “ভূত!”

তপন পিছু হটতে গিয়েও থমকে গেল, কারণ একটা কঙ্কালসার হাত গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো!

---

ভয়ের আসল সত্য 

নীলুর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল, কিন্তু সে পালাল না। সে এক হাতে টর্চটা উঁচু করল, আর যা দেখল তাতে চোখ কপালে উঠে গেল।

একজন বৃদ্ধ মানুষ, ছেঁড়া কাপড় গায়ে, গাছের গুঁড়ির পেছন থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলেন।

রাজা ফিসফিস করে বলল, “এ কি… ভূত?”

বৃদ্ধ কাঁপা গলায় বললেন, “না বাবা, আমি ভূত নই… আমি শুধু একজন অসহায় মানুষ।”

নীলু বিস্মিত হয়ে বলল, “আপনি এখানে কী করছেন?”

বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি রমেশ। অনেক বছর আগে এই গ্রামেই থাকতাম। কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময় ঘরদোর হারিয়ে পথে নেমেছিলাম। তারপর থেকে এই গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছি। কেউ আমাকে দেখতে পেলে ভয় পেয়ে পালায়, তাই আমি দিনের বেলা লুকিয়ে থাকি, রাতে খাবারের খোঁজে বেরোই।”

তপন অবাক হয়ে বলল, “তাহলে রাতে কান্নার শব্দ…”

রমেশ মাথা নিচু করে বললেন, “হয়তো ক্ষুধার্ত অবস্থায় আমার কষ্টের শব্দ তোমরা শুনেছো।”

সব শুনে রাজা হতবাক হয়ে গেল। এতদিন গ্রামের মানুষ ভূতের ভয়ে এখানে আসত না, অথচ এখানে ছিল একজন ক্ষুধার্ত, অসহায় মানুষ!

---

 অন্ধকার থেকে আলোয় 

পরদিন সকালে, নীলু, রাজা আর তপন গ্রামের সবাইকে ডেকে আনল। তারা পুরো গল্পটা খুলে বলল।

প্রথমে অনেকে বিশ্বাস করতে চায়নি, কিন্তু যখন নিজের চোখে রমেশকে দেখল, তখন তারা লজ্জিত হলো।

গ্রামের লোকেরা মিলে রমেশকে থাকার জায়গা দিল, খাবারের ব্যবস্থা করল।

বটগাছটাকে এখন কেউ ভয় পায় না। সন্ধ্যায় সেখানে বসে গল্প হয়, গানের আসর বসে, বাচ্চারা খেলে।  আর নীলু? সে হয়ে উঠল গ্রামের সবচেয়ে সাহসী ছেলে, যে অন্ধবিশ্বাসকে ভেঙে সত্যকে সামনে এনেছে।

---

শিক্ষা 

কুসংস্কার আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখে। আসল সাহস হলো ভয়কে জয় করে সত্যের মুখোমুখি হওয়া।