বাংলার নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এক বিরাট অবদান আছে। প্রথম যে বিপ্লবী কান্ডটি ঘটিয়েছিলেন সেই মানুষটি কবি সাহিত্যিক লেখক রবীন্দ্রনাথ নয় বরং জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই দিনটিতে জমিদার আমলে একটি প্রথা প্রচলন ছিল। জমিদারেরা তাদের সারা বছরের খাজনা নিয়ে নবাবের কাছে হাজির হতেন আর এই দিনটিতে সাধারণ মানুষেরা তাদের খাজনা নিয়ে জমিদারের কাছে উপস্থিত হতেন। এই দিনটিকে পূন্যাহ বলে বর্ণনা করা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পূন্যাহ র দিনেই এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন ।যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। ঠাকুরবাড়ির চিরাচরিত নিয়ম ছিল পুন্যাহর দিন প্রজারা হিন্দু-মুসলমান দুই দু দলই আলাদা আলাদা করে আসন গ্রহণ করবেন। হিন্দুদের জন্য থাকবে চাদর তার উপরে শতরঞ্চি আর মুসলমান প্রজারা বসবেন চাদর ছাড়া কেবল শতরঞ্চির উপরে। আর জমিদার বসবেন এক ভেলভেট মোরা সিংহাসনে। জমিদার রবীন্দ্রনাথের আদেশে পূর্ণ্যাহর দিনে এই ব্যবস্থা পুরোপুরি উঠে গেল। এক আসনে বসলো সবাই। হিন্দু, মুসলমান
জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই একইসঙ্গে একই আসনে তাদের সঙ্গে বসলেন। রবীন্দ্রনাথ বহু গান কবিতা প্রবন্ধ ভাষনে বর্ষবরণের প্রধান কথা তুলে ধরেছেন। তৎকালীন ভারত ও বিশ্বের কথা উল্লেখ করেছেন তেমনি উপনিষদ থেকে উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল দর্শন উন্মুক্ত করতে পেরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন পোশাকি আনন্দে মাতোয়ারা হওয়াই একমাত্র আনন্দ নয়, আনন্দ কে অন্তরে ধারণ করতে হয়। তবেই সে আনন্দ সার্থক হয়ে ওঠে। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজি ১৯০১ এ। ১৯০২ এ যা বাংলা মতে ১৩০৯ র পয়লা বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ আশ্রম আয়োজন করেছিলেন প্রথম নববর্ষ উৎসব ।সেটা ছিল ইংরেজি ১৯০২ আর দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল সোমবার। এই দিনটিতে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে যোগ দিয়েছিলেন, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মোহিত চন্দ্র সেন এবং আরো অনেকে। কালবৈশাখী প্রবল ঝড়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠে গান আমায় কর তোমার বীণা, পরিবেশিত হয়েছিল। প্রাতঃকালীন উপাসনার পর রবীন্দ্রনাথ নববর্ষ নিয়ে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন সংসারের কোন বাহ্য ঘটনাকে আমার চেয়ে প্রবলতম মনে করিয়া অভিভূত হইব না
কারণ ঘটনাবলী তাহার সুখ দুঃখ বিরহ মিলন লাভ-ক্ষতি জন্ম মৃত্যু লইয়া আমাদিগকে ক্ষণে ক্ষণে স্পর্শ করে ও অপসারিত হইয়া যায়। বৃহত্তম বিপদই বা কত দিনের। মহোত্তম দুঃখই বা কতখানি। দুঃসহতম বিচ্ছেদই বা আমাদের কতটুকু হরণ করতে পারে তাহার আনন্দ থাকে। দুঃখ যেন আনন্দেরই রহস্য মৃত্যু যেন সেই আনন্দেরই রহস্য।
কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নববর্ষের দিনটিকে নিজের জন্মদিন পালনের দিন হিসেবে নির্বাচন করলেন। বৈশাখের প্রবল গরমের জন্য শান্তিনিকেতন কে বন্ধ রাখতে হতো। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ও নববর্ষ উৎসব একসঙ্গে পালন করে নেওয়া হতো। বিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয় বা পঠন-পাঠনের ছুটি থাকত।
১৯৩৬ সাল থেকে জীবনকালের শেষ দিন পর্যন্ত এভাবেই হয়েছে। এখনো শান্তিনিকেতনে নববর্ষের দিনই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালিত হয়। উদযাপনে আনুষ্ঠানিকতাই নয় তার গানে কবিতায় গল্পে নাটক এবং প্রবন্ধে চিঠিপত্রের চিন্তাভাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে। কখনো কখনো নববর্ষ কে আহ্বান করছেন স্বদেশী আনার আহবানে। নববর্ষে করলাম পণ লব স্বদেশের দীক্ষা/তব আশ্রমে তোমার চরণে হে ভারত লবো শিক্ষা। পরিশেষে কাব্যগ্রন্থের গৃহলক্ষী কবিতায় নববর্ষ কে তিনি আহ্বান জানাচ্ছেন এভাবে- নবজাগরণ লগনে লগনে বাজে কল্যান শঙ্খ। এসো তুমি ঊষা ওগো/আনো দিন নিঃশঙ্ক। আবার কখনো, নববর্ষ এলো আজি দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে।
১৯৪০ সালের নববর্ষ ও কবির জন্মোৎসবে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে গানের সঙ্গে কবির বিভিন্ন রচনা থেকে পাঠ চলছে। ‘শান্তিনিকেতন’ সঙ্কলন থেকে পড়া হয়েছিল ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধ— ‘এই ব্রাহ্মমুহূর্তে আমরা আশ্রমবাসীরা আমাদের নূতন বৎসরের প্রথম প্রণামটিকে আমাদের অনন্তকালের প্রভুকে নিবেদন করবার জন্যে এখানে এসেছি। এই প্রণামটি সত্য প্রণাম হোক।’
১৯৪১ সালের পয়লা বৈশাখেও পঁচিশের শঙ্খধ্বনি বেজেছিল। পরদিন ১৫এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর ছাপা হল, ‘সূর্য্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে মন্দিরে উপাসনা আরম্ভ হয়। অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন আচার্য্যের আসন গ্রহণ করেন।...অনুষ্ঠানে কয়েকটি সঙ্গীত গান করা হয়। ইহার মধ্যে দুইটি কবিগুরু কর্ত্তৃক এই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে রচিত — ‘হে পুরুষোত্তম’ এবং ‘এস হে মহামানব’। (ঐ মহামানব আসে)। সে দিন কবির জন্মোৎসবের ভাষণ ছিল ‘সভ্যতার সংকট’। পয়লা বৈশাখ, ১৯৪১। রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ নববর্ষ। এই দিনই তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত ঐ মহামানব আসে গানটি। এই নিয়ে শান্তিদেব ঘোষের স্মৃতিচারণা আছে এই গান রচনার অনুরোধের গল্প— “প্রথমে আপত্তি করলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে বললেন ‘সৌম্য [ঠাকুর] আমাকে বলেছে মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতে। সে বলে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি মানবের জয়গান করিনি। তাই একটা কবিতা রচনা করেছি, সেটাই হবে নববর্ষের গান।’
এতো খালি গান নয় কবিতা নয় তখনকার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রাম চলেছে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবিতে। এই গানগুলি এক আলাদা তাৎপর্য বহন করে আনতো সাধারণ মানুষের কাছে। এই গান এই বাণী তাদেরকে উদ্দীপ্ত কত অনুপ্রেরণাও যোগাত।
শান্তিনিকেতন গ্রন্থের নববর্ষ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন মানুষের নববর্ষ আরামের নববর্ষ নয়। সে এমন শান্তির নববর্ষ নয় পাখির গান তার নয় অরুণ্য আলো তার আলো নয়। তার নববর্ষ সংগ্রাম করে আপন অধিকার লাভ করার সংগ্রাম। আবরণের পর আবরণ কে ছিন্ন বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় হয়। এই কথাগুলি শুধু তো কথার কথা নয় সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষের চেতনার মানুষের অগ্রগতির কাব্য কথা। যার মধ্যে মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসের ধারাই উন্মোচিত হয়েছে।
অনেক কবিরাই নববর্ষ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন রচনা করেছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে বাঙালির নববর্ষ এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল। তিনি বাঙালির ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দিতে পেরেছেন এবং ভাবি দিনের জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত হবার কথাও বলতে পেরেছেন। নববর্ষ খালি আনন্দ উৎসবের অনুষ্ঠান নয় এটি একটি দায়িত্ব গ্রহনের অনুষ্ঠান হতে পারে রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে প্রথম দেখাতে পেরেছিলেন। অন্য কবি লেখকদের সাথে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এখানেই। বাঙালির নববর্ষ উৎসব পালনের রূপ রূপান্তরের যে ছোঁয়া লেগেছে আমাদের সৃষ্টিশীল ভুবনের দিকে দৃষ্টি দিলে তা সহজেই বোঝা যাবে। মধ্যযুগের কবিদের রচনায় বৈশাখ এসেছে প্রথমত প্রাকৃতিক অনুসঙ্গে
রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে জীর্ণ পুরাতনকে সারিয়ে নতুনদের আহ্বানের উৎস হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ জীর্ণ পুরাতন গতানুগতিক জীবনকে বর্জন করে বৈশাখের আগমনে নতুন সত্তা দিয়ে সকলকে জাগ্রত করার আহ্বান জানান।