আলেকজেন্ডারের দিগ্বীজয়

কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

প্রতিদিন সকালে আলেকজেন্ডারের জন্য পাড়ার মহিলারা হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। আলেকজেন্ডার পাড়ায় না আসলে মহিলাদের মাথায় হাত পড়ে যায়, কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। আলেকজেন্ডার আসলে ময়লা ফেলার গাড়ি টানে। ময়লা ফেলার ভ্যান টানতে টানতে ও হুইসল  বাজায়। আলেকজেন্ডারের বয়স ১৫/১৬ হবে। মাত্র তিন বছর বয়সে আলেকজেন্ডারের বাবা মারা যায়। তখন আলেকজেন্ডার আর ওর মা খুব বিপদে পড়ে।  কোথায় যাবে, কি করবে ভেবেই কূলকিনারা করতে পাচ্ছিলো না আলেকজেন্ডারের মা। তখন দেবদূতের মতোই এগিয়ে এসেছিলো মিঃ টমাস। মিঃ টমাস ছিলেন কোম্পানির বড়ো অফিসার। নিজের বাংলোর আউটহাউসে থাকার ব্যাবস্থা করেছিলেন মা, ছেলের। বিনিময়ে আলেকজেন্ডারের মা ওনার রান্নাবান্না আর ঘরের কাজ করে দিতো। মিঃ টমাসই  আলেকজেন্ডার নামটা দিয়েছিলেন। তিনিই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন শিশুটিকে। তার মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। আমার বন্ধুরা অত বড়ো নামে ওকে ডাকতে পারতো না। তারা ওর নাম রেখেছিলো আকু। আকুর মা বিন্তির একটাই স্বপ্ন ছিলো যে আকু একদিন অনেক বড়ো হবে টমাস সাহেবের মতো। টমাস সাহেব ওদের দুজনকে নিজের জীবনের গল্প শোনাতেন।  নিজের জন্ম হয়েছিল ফুটপাথে । সেখান থেকেই লড়াই করে আজ এ জায়গায় পৌঁছেছেন। চোখ বড়ো বড়ো করে শুনতো আকু। মিঃ টমাসের কথাগুলো তার কানে ঝর্ণা মতো ঝরে পড়ে, “মাই সন, অলওয়েজ হেল্ড ইওর হেড হাই। নেভার বি এশেমড  অফ এনি জব।” দুনিয়ার উচ্ছিস্ট আবর্জনা টেনে চলতে চলতেই মনে পড়ে আকুর সেই সব কথা। না ভ্যান টানতে লজ্জা লাগেনা আকুর। কিন্ত টমাস সাহেবের কথা মনে পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায় তার। মাত্র দুবছর আগে আচমকাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মিঃ টমাস। আকুর তখন ১৩/১৪ বছর বয়স হবে। আলেকজেন্ডার যেন দ্বিতীয়বার পিতৃহারা হলো। এরপর বড়ই কঠিন হয়ে পড়লো তাদের জীবন। আকুর মা লোকের বাড়ি কাজ ধরলো। আকু ভ্যান টানতে শুরু করলো। তাতে অনেকটা সুরাহা হলেও মাথার উপর ছাদের কি ব্যাবস্থা হবে! এই  ভেবে ভেবে মাথা খারাপ অবস্থা। এলাকার নেতা, দাদাদের ধরে শেষমেষ বস্তিতে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো মা ছেলের। আকু তাতেই খুশী। পড়াশোনা তো করা যাবে, তাহলেই হলো। সন্ধ্যাবেলা কয়েকজন দাদা, দিদি আসে ওদের বস্তিতে। ওরা খুব দরদ দিয়ে ওদের নানা কঠিন বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেয়। ওরা নিজেরা নাকি নামী কলেজের ছাত্র ছাত্রী। আকুকে ওরা এতো বই দিয়েছে যে আকুর কোনো অসুবিধাই হয়নি। বইয়ের পাতায় পাতায় যেন মিঃ টমাসকে দেখতে পায় আকু। আর দেখে স্বপ্ন। এক বিরাট মাপের মানুষ হয়েছে সে। মিঃ টমাস তাকে শিখিয়েছিলেন যে সবসময়ই যেন স্বপ্ন তার সঙ্গেই থাকে আর স্বপ্নকে সফল করার জন্য থাকে জেদ আর অধ্যাবসায়। আকু তাই অনলস পরিশ্রম করে চলে। অবশ্য এই  দাদা, দিদিরা কখনও তাকে আকু বলে ডাকে না। ওকে আলেকজেন্ডার নামেই ডাকে। ওদের উৎসাহে আর সঞ্জিৎ  স্যার  আর প্রিন্সিপাল স্যারের সাহায্যে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে আলেকজেন্ডার।

  আজ পাড়াটা যেন কেমন থমথমে। ঘোষ গিন্নী আর  দত্ত গিন্নীর হাঁকডাক যেন মিইয়ে গেছে। ঘোষ বাড়ির  ছেলে কোনোরকমে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে আর দত্ত গিন্নীর একমাত্র ছেলে তো সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছে। কিন্ত তার চেয়েও বেশি মনখারাপের কারণ আছে। টিভিতে বারবার দেখাচ্ছে যে জেলার প্রথম আর রাজ্যের দ্বিতীয় হয়েছে আলেকজেন্ডার সরকার। একটা বাপ মরা বস্তির ছেলে, যে কিনা ময়লা ফেলার ভ্যান টানে, সেই রাজ্যে দ্বিতীয়। প্রথম স্থানাধিকারীর চেয়েও তাই দ্বিতীয় স্থানাধিকারীকে নিয়ে বেশি হইচই  হচ্ছে। সেই এন জি ও র দাদা দিদিরা খুশিতে পাগল। আলেকজেন্ডারের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী। সাংবাদিকদের ভিড় লেগে গেছে আলেকজেন্ডারের বস্তিবাড়িতে। কিন্ত সেখানে এখন কেউ নেই। আলেকজেন্ডারের মা লোকের বাড়ি বাসন মাজতে বেরিয়ে গেছে আর আলেকজেন্ডার ময়লার ভ্যান টানছে এখন। সে এখনও জানেনা সে কি কান্ড ঘটিয়েছে। ঘোষ  গিন্নী আজ ওর সামনেই আসতে পারেনি আর দত্ত গিন্নী কোনো কথা বলতে পারেনি ওকে। এক সচিব পর্যায়ের আমলা এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেন, “আরে ছেলেটা গেলো কোথায় একটু খুঁজে দেখুন না মশাই!” “জানলে এতক্ষণে ব্রেকিং নিউজ করে ফেলতাম না!” “মোবাইলে দেখুন। পান কিনা।” “ভালো বলেছেন। মোবাইল ও পাবে কোথায়! শুনছেন না নুন আনতে পান্তা ফুরায়!” 

টিভির সংবাদ পাঠক তখন প্রবল উৎসাহে চিৎকার করে বলছেন, “ভাবুন একবার। গারবেজ ভ্যান চালিয়ে দিন গুজরান করা ছেলে, যার বাবা নেই, মা অন্যের ঘরে কাজ করে সেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয়। কিন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তার কাছে কোনো মোবাইল ফোন নেই। আমাদের সাংবাদিক তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। আলেকজেন্ডার সরকারের খোঁজ পেলেই আপনাদের জানাবো।”

সব চ্যানেলের সাংবাদিক আর বড়ো আমলারাও যাকে পাগলের  মতো খুঁজে চলেছে সেই  আলেকজেন্ডার সরকার তখন একটা কেমিস্ট্রির ইকুয়েশনের কথা চিন্তা করতে করতে একটা বাড়ির থেকে ময়লা তুলে ভ্যানে ফেলছিলো। দিগ্বীজয় কি সহজে হয়?