বাসস্ট্যান্ড। কিছু ছাত্র-ছাত্রী স্কুল বাসের প্রতীক্ষায়। ক্লাস ফাইভ-সিক্সের একজন ছাত্রের প্রশ্ন। ডাইনোসরের আগে কোন জীবজন্তু ছিল কিনা। প্রশ্নটা শোনার আগেই একজন ছাত্রী বললো “পড়ার বোঝাটা একটু কমলো।” একজন জিজ্ঞাসা করল ‘কিভাবে?’ জবাব ডারউইনের বিবর্তনবাদ আর মুঘল যুগ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ। একজন নিয়ে এলো বিক্রমের চাঁদের পিঠের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের প্রসঙ্গ। স্কুলের বাস এল। ওরা সারিবদ্ধ ভাবে বাসে উঠল। কিছুক্ষণ বাদে আমার বাস। গন্তব্য হসপিটাল।
ছাত্র-ছাত্রীদের এলোমেলো শব্দগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে তৈরি এই কথামালা ‘ডাইনোসর-ডারউইন-বিক্রম’।
আকাশ ভরা সূর্য তারা
মহাজগৎ সৃষ্টির আধুনিক তথ্য বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে এক হাজার কোটি বছর আগে অতি ঘনত্ব ও অতি উচ্চচাপবিশিষ্ট অতি ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে এক মহাবিস্ফোরণের ফলে স্ফীত হয়ে এই মহাজগতের সৃষ্টি।
বিস্ফোরণের মুহূর্ত থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই মহাজগতের এই অতি উচ্চ্চ তাপ মাত্রা পনের শত হাজার মিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন এক হাজার মিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন স্তরে নেমে যায়। এই তীব্র তাপীয় প্রসারণ ও সঙ্কোচনের কারণে নিউট্রিনো, ইলেকট্রনের মতে মৌল পদার্থকণা, নিউট্রন ও প্রোটোন এর মত যৌগ পদার্থকণা এবং শক্তিকণা ফোটোন এর সৃষ্টি হয়। পরে তাপমাত্রা আরো কমলে প্রোটন নিউট্রন এবং ইলেকট্রন সংযোজিত হয়ে তৈরি করে হাল্কা পরমানু। প্রথমে হাইড্রোজেন, ডয়েটরিয়াম, ট্রিটিয়াম এবং পরে হিলিয়াম তৈরি হয়। বিজ্ঞানীদের মতে হিলিয়াম সৃষ্টির সৃষ্টি থেকেই আকাশ ভরা সূর্য তারা সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রকৃতির নিয়মেই হিলিয়াম তারাদের ভিতর জ্বলন প্রক্রিয়া ঘটিয়ে চলেছে। এর ফলেই অন্যান্য মৌল ভারী পদার্থ যেমন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন, সোডিয়াম, লোহা ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। আমাদের সূর্য একটি তারা, আমাদের পৃথিবীও মহাবিস্ফোরণের ফলেই গড়ে ওঠে।
প্রাণ ও প্রাণীর সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর প্রকৃতি। বিগ ব্যাং এর ঘটনার পর তারা, নীহারিকা, ছায়াপথ সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই প্রক্রিয়াতেই ৫০০ কোটি বছর আগে গ্যাসীয় অগ্নিগোলক রূপেই পৃথিবীর জন্ম। ১৫০ কোটি বছর পর্যন্ত পৃথিবী গ্রহে কোন প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না। ৩৫০ কোটি বছর আগে হঠাৎ শুরু বৃষ্টি ঝড়। কয়েক হাজার বছর ধরে চলেছিল এই ঝড় বৃষ্টি। এর ফলেই মহাসাগর সাগর বৃহৎ হ্রদ গড়ে ওঠে। পৃথিবীর উপরতল শীতল হতে থাকে এবং ক্রমেক্রমে স্থলভাগের উৎপত্তি ঘটে।
বৃষ্টির জলে নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থ খনিজ পদার্থ এবং লবণ ছিল। বজ্রবিদ্যুৎ শক্তির প্রতিক্রিয়ায় সমুদ্রে প্রাণ সৃষ্টির সবুজ সংকেত মিলল।
প্রকৃতিতে থাকা সরল অনুগুলোর মিলন সংঘর্ষের ফলে জটিল অনুর সৃষ্টি হয়। এই জটিল বিক্রিয়ার ফলে এককোষী প্রাণী এবং এককোষী থেকে দ্বিকোষী, বহুকোষী প্রাণীর বিকাশ ঘটে। আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ার শিলাস্তরে আদি প্রাণীর ফসিল আবিষ্কৃত হয়। সূক্ষ সুতোর মত গঠন,কিছুটা নীল সবুজ অ্যালগির মত দেখতে। নাম সায়নো-ব্যাকটেরিয়া। ৩৩০ কোটি বছর আগে এই সাইনো-ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয় মহাসমুদ্রে। অথর্ব বেদেও সমুদ্রেই প্রাণ সৃষ্টির কথা আছে।
এই প্রথম প্রাণীর কোষ বিভাজন ডিএনএ বদলে যাওয়ার কারণে সমুদ্রে পোকামাকড়, নানা প্রজাতির উদ্ভিদের জন্ম হয়। এইসব উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষের (ফটোসিন্থেসিস) মাধ্যমে খাদ্য ও অক্সিজেন তৈরি করতে সক্ষম হয়। পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অক্সিজেন ছাড়া প্রাণী বাঁচে না।
নানান প্রজাতির কীটপতঙ্গ উদ্ভিদ ইত্যাদির বিবর্তনের ফলে ৫৩ কোটি বছর আগে মাছেদের আবির্ভাব। মাছেদের আগমন বৈচিত্রের সৃষ্টির উৎস। জোয়ার ভাটার কারণে সামুদ্রিক প্রাণীরা স্থলভাগে মাঝে মাঝে চলে আসে। উদ্ভিদ থেকে স্থলভাগে নানা প্রজাতির বৃক্ষের অরণ্য বিস্তৃত হতে থাকে। যেসব মাছ স্থল ও জলে যাতায়াত করত তাদের দেহের দুপাশের পাখনা ক্রমশ শক্ত হয়ে উভচর সরীসৃপে এবং যেসব মাছ জলে না ফিরে স্থলেই নিজেদের অভিজিত করে তারা স্থলভাগে শরীর রূপে রূপান্তরিত হয়। মাছের পাখনা গুলি স্থলে বিচরণ করার মতো শক্ত পায়ে পরিণত হয়। স্থলের মাটি গাছ ও পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করে। ৩৩ কোটি বছর ধরে মাছেদের বিবর্তন প্রক্রিয়াজাত সরীসৃপ থেকে কুড়ি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ছোট আকারের ডাইনোসরের আবির্ভাব। ডাইনোসদের সাম্রাজ্য চলে ১৪ কোটি বছর ধরে। আজ থেকে ৬ কোটি বছর আগে সমস্ত প্রজাতির ডাইনোসরদের অবলুপ্তি ঘটে।
শুধু ডাইনোসর নয়, অন্যান্য বহু জীব, পাখি, উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা শকুন চড়ুই দেখতে পাই না। বৈজ্ঞানিক ডারউইন তার বিবর্তনবাদ তত্ত্বে এই প্রাণী-বিলোপের ঘটনাকে ‘প্রকৃতির নির্বাচন’ বলেছেন। প্রকৃতির নির্বাচনে অনুপযুক্তদের ঠাঁই নেই। প্রকৃতির সাথে অভিযোজিত করার যোগ্যতা হারালে কোন প্রাণী তাদের অস্তিত্ব রাখতে সক্ষম হবে না। প্রকৃতির প্রতিটা স্তরে আবহাওয়া বা অবস্থার সাথে যে প্রাণী নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে সেই প্রাণী প্রকৃতিতে টিকে থাকে। বাঁচার নানা প্রচেষ্টার ফলে ডিএনএ বদলে যায়।
কোন অতি মানব মানুষ তৈরি করেনি। কয়েক কোটি বছর ধরে নানা প্রজাতির জীব বিবর্তিত হয়েছে। এক প্রাইমেট্ প্রজাতির বিবর্তিত রূপ আধুনিক মানুষ। সরীসৃপ থেকে যেমন ডাইনোসরদের উৎপত্তি তেমনি সরীসৃপ থেকে পাখিদেরও জন্ম। আবার স্তন্যপায়ী জীব বা বাদুড় আকাশে প্রাণীদের পাখিদের মতোই উড়তে শিখলো ডানা মেলে। জুরাসিক যুগেই ডাইনোসরদের সমসাময়িক বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব জন্তুর আবির্ভাব ঘটে। যেমন হাতি গন্ডার ইত্যাদি চতুষ্পদী জীবদের পূর্বপুরুষ বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ। বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে জীব শরীরের পরিবর্তনের কারণেই বিভিন্ন প্রজাতির জীবের উদ্ভব হয়।
এই স্তন্যপায়ী জীবদের কিছু প্রজাতি বৃক্ষবাসী হয়ে যায়। এদেরই একটা প্রজাতি প্রাইমেট্। প্রাইমেট্রা নর-বানরের পূর্বপুরুষ। নর-বানর আমাদের পূর্বপুরুষ। অতএব প্রাইমেট্রা আমাদেরও পূর্বপুরুষ। নর-বানরদের কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে গরিলা, ওরাং ওটাং, শিম্পাঞ্জিদের সাথে আমাদের পরিচয় আছে। এই সকল নরবানররা সামনের পা দুটো হাতের কাজে লাগাতে শুরু করে। এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে চলার সুবিধার জন্য। অবশ্য প্রাইমেট্দের সামনের পা দুটো হাতে রূপান্তরিত হয়েছিল। নরমানবদের হাত আরো সুগঠিত রূপ পেল। এই নরবানর কোন প্রজাতির ডিএনএর পরিবর্তন ফলে সৃষ্টি প্রাক্-মানুষের। নর-বানর আর প্রাক্-মানুষ প্রজাতিকে একত্রে বলা হয় হোমিনয়েড। হোমিনয়েড গোষ্ঠী কয়েক লক্ষ বছর একসাথেই বাস করে। প্রজাতি গুলির মধ্যে ডিএনএ পার্থক্য থাকায় আচার-আচরণে পার্থক্য ঘটতে থাকে। ফলে ৭৬ লক্ষ বছর আগে গরিলারা হোমিনয়েড গোষ্ঠী থেকে সরে গিয়ে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বাস করা শুরু করে। প্রাক-মানুষ আর শিম্পাঞ্জিরা আরও ১৬ লক্ষ বছর একসাথে ছিল। এই সময়ের মধ্যে প্রাক্-মানুষ দু পায়ে হাঁটতে শিখে যায়। যদিও প্রথমদিকে দুই পায়ে হাঁটলেও সোজা হয়ে হাঁটতে পারত না। এই হাঁটার সময় থেকেই শিম্পাঞ্জিরা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ করে ৬০ লক্ষ বছর আগে।
৫৮-৫৯ লক্ষ বছর ধরে এই প্রাক্-মানুষ মানুষ প্রজাতির গঠনের দিকে অগ্রসর হয়। হাঁটার সাথে সাথে পাথরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শেখে। ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে জন্ম নেয় আধুনিক মানুষের আদি মাতা প্রাক-মানবীর গর্ভ থেকে। আদি মাতার জন্ম আফ্রিকায়। আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তার বংশধরদের সংখ্যা ৮০০ কোটি।
মানুষ বিজ্ঞান প্রযুক্তি শ্রম বুদ্ধিরর সাহায্যে করছে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ। এমনকি বদলেও দিচ্ছে। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সফল চন্দ্রযান-৩ এর সাহসী অভিযান বিশ্বের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে পেয়েছে অভিনন্দন। চন্দ্রযান-৩ থেকে ল্যান্ডার বিক্রমের চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফল অবতরণ যুগান্তকারী, কারণ কোন দেশ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান পাঠাতে সক্ষম হয়নি। বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদ শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম সাধনার এই সাফল্যের জন্য ধর্মান্ধ কিছু মানুষ যাগ-যজ্ঞ, মন্দির মন্দিরে পুজোকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ধর্মান্ধদের প্রধান উদ্দেশ্য হল বৈজ্ঞানিক সত্যকে অস্বীকার করে যুক্তিহীন অস্তিত্বহীন অতি মানব দেবতাদের জয়গান করে আমাদের বিজ্ঞানমনস্কতাকে ধ্বংস করা। এই পরিকল্পিত লক্ষ্য ডারউইনের বিবর্তনবাদকে ডিলিট করতে চাইছে। দেশবাসী যাতে মানবজাতির জন্ম রহস্যকে জানতে না পারে। ঐতিহাসিক সত্যকেও এরা অস্বীকার করে। তাই ভারতের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায় মুঘল যুগের গুরুত্ব কে অস্বীকার করছে। কিন্তু কুসংস্কার ধর্মান্ধতা অপবিজ্ঞান বিকৃত ইতিহাসের লোহার প্রাচীর বিজ্ঞানের অগ্রগতি রুদ্ধ করতে সফল হবে না। আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আমাদের সৃষ্টি আদিত্য-১ সূর্যাভিমুখী।