রাধানাথবাবু দিন দশেক হলো এই পাড়ায় এসেছেন। শিবমন্দিরের কাছে ব্যানার্জিদের বাড়িটা কিনে একটু আধটু রিপেয়ারিং করিয়ে, পুরোনো বাড়িটাকে একদম নতুনের মতো করে তুলেছেন রাধানাথবাবু। তিনি সরকারি অফিসের কর্মী। ছেলে মঙ্গল, মেয়ে ছুটকি আর স্ত্রী মিনতিকে নিয়ে তাঁর সংসার। এই ব্যানার্জিবাড়ির পিছনের দিকে একটা বাগান আছে, লোকে সেটাকে ব্যানার্জিদের বাগান বলে। আম, পেয়ারা, খেজুর ও আরও কত ধরনের গাছ সেখানে আছে। বহুদিন এই বাড়িতে কেউ থাকতো না। ফলে ব্যানার্জিদের বাগান হয়ে উঠেছিলো পাড়ার কম বয়সী ছেলেদের খেলার প্রিয় জায়গা। এখন এই রাধানাথবাবু এই বাড়িতে আসার পর পাড়ার ছেলেরা পড়েছে মহা সমস্যায়। ছেলের দল পাঁচিলের আশেপাশে ঘুর ঘুর করে, কিন্তু ঢুকতে সাহস পায় না।
এমনই এক রবিবার সকালে ছেলের দল ব্যানার্জি বাড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড় বাঁধের ধারে গিয়ে বসলো। এই দলের সর্দার মন্টু নিজের মনেই বলে উঠলো- ‘আমাদের সাধের বাগানে আর আমারা ঢুকতে পারবো না মনে হয়!’ তপু বললো – ‘হ্যাঁ মন্টু দা, ওই বাগানের মিষ্টি পেয়ারাগুলোর জন্য আমার মন কেমন করছে’। এইসব নানা আলোচনার মাঝে বিট্টু বলে একটি ছেলে বললো- ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। ওই বাড়িতে যে নতুন ছেলেটা এসেছে তাকে যদি আমাদের দলে আনতে পারি, তবে একটা উপায় হতে পারে’। সবাই হাঁ করে বিট্টুর আইডিয়াটা শুনছিলো। মন্টুই প্রথম মুখ খুললো- ‘কথাটা ভালো বলেছিস। কিন্তু দলে আনবো কী করে? ওর সাথে তো পরিচয়ই নেই। তাছাড়া ও অন্য স্কুলে পড়ে।’
এটাও ঠিক যে মঙ্গল ওদের স্কুলে পড়ে না। রোজ সকালে গাড়ি এসে ওকে স্কুলে নিয়ে যায় আর সেই গাড়িতেই ও ফিরে আসে, যার ফলে পরিচয় তো দূরের কথা মঙ্গলকে এখনও পর্যন্ত দেখেওনি পাড়ার ছেলেরা। শুধু শুনেছে ওই বাড়িতে একটা নতুন ছেলেও এসেছে। ছেলের দল গভীর চিন্তা করতে করতে যে যার বাড়িতে ফিরে গেল। ব্যানার্জিদের বাগানে ঢোকার কোন রাস্তা বার হল না।
এই ভাবেই আরো সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেছে। বাস্তবকে মেনে নিয়ে ছেলের দল নতুন খেলার জায়গা খুঁজে নিয়েছে। এখন তারা পালদের খামারে খেলা করে। একদিন সবাই খেলছে এমন সময় বিট্টু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো- ‘মন্টু দা, খবর আছে’। সবাই খেলা থামিয়ে বিট্টুর কাছে এগিয়ে এলো। বিট্টু একটু দম নিয়ে বললো, ‘আমাকে আজ নতুন বাড়ির লোকটা ডেকে বললো আজ সন্ধেবেলায় ওনার ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হবে। আমরা সবাই যেন যাই।’ মন্টু অবাক গলায় বলল- ‘সবাই!’ বিট্টু বেশ জোরে বললো এবার, ‘হ্যাঁ গো সবাই। উনি বললেন–“আমি তো তোমাদের সবার নাম জানি না, বাড়িও চিনি না, তাই এভাবে রাস্তার মাঝখানে নেমন্তন্ন করলাম। সবাইকে নিয়ে আসবে অবশ্যই”।
খুশিতে সবার চোখ চিক চিক করে উঠলো।মন্টু বললো- ‘আজ যেভাবেই হোক, ওই ছেলেটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই হবে’। সেদিনের খেলা ওখানেই শেষ। সন্ধেবেলা ব্যানার্জি বাড়িতে গিয়ে কিভাবে কি করা যায় তার পরিকল্পনা করতেই সবাই মশগুল হয়ে গেল।
সন্ধেবেলা সেজেগুজে ছেলের দল একসঙ্গে হাজির হল ব্যানার্জিদের বাড়িতে। কলিং বেল টিপতেই এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। ওদের দেখে হাসি মুখে বললেন- ‘বাহ্, তোমরা সবাই এসে গেছো। খুব ভালো। ভেতরে এসো’। ওঁর পিছু পিছু ছেলেরা ভেতরে ঢুকলো। ঘরটা বেলুন দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলে বড়সড় একটা কেক রাখা আছে। ছেলের দল এসবই দেখছিল, যদিও তাদের দু’চোখ খুঁজছিলো সেই ছেলেটাকে, যার জন্মদিন উপলক্ষে এত আয়োজন। কিন্তু অনেক উঁকিঝুঁকি মেরেও ওরা কিছু দেখতে পেল না। সেই ভদ্রমহিলা ওদেরকে এই ঘরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেছেন। এখন কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবার উপায় নেই।
মন্টু বিট্টুর কানে কানে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ভেতরের ঘর থেকে সেই ভদ্রমহিলা একটা হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে এলেন। ছেলেরা দেখলো সেই চেয়ারে হাসিমুখে বসে আছে ওদেরই বয়সী একটা ছেলে। ভদ্রমহিলা চেয়ারটা ওদের সামনে এনে বললেন- ‘এ হচ্ছে মঙ্গল। আজ ওর জন্মদিন। ওর খুব ইচ্ছে তোমাদের সঙ্গে খেলার। তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য ও তো তোমাদের সাথে খেলতে যেতে পারবে না। তাই তোমরা যদি আসো আমাদের বাগানে, তাহলে ওর ভালো লাগবে। তোমরা কী আসবে?’
মঙ্গলের হাসি হাসি মুখে এমন একটা ব্যাপার ছিলো যে ছেলের দলের মনে হলো, সে যেন ওদের অনেক দিনের পরিচিত। কেউ কিছু বলার আগেই দলের সর্দার মন্টু বলে উঠলো- ‘নিশ্চয় আসবো। মঙ্গল এখন থেকে আমাদের সঙ্গেই খেলবে। ও আমাদের নতুন বন্ধু।’ মন্টুর কথা শুনে সব ছেলেরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো। ওদের দেখে চেয়ারে বসে মঙ্গলও হাততালি দিতে থাকে...