(জানি আমার এ গল্পটা তুমি পড়বে না কোনোদিন,
থাকলো না হয় মালালা য়ুসুফজাই তোমার কাছেই ঋণ)
ভোরের ফজরের নামাজের স্বর ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এলো। বাড়ির দেয়ালের গায়ে যে জানলার মত খোপ কাটা গর্ত আছে, তা দিয়ে পুব আকাশের আলো এসে অন্ধকার ঘরটাকে যেন নাড়া দিয়ে ডাকছে - জাগো - ওঠো -
কেলাৎ ই ঘিলজাই শহরের ঘুম ভাঙছে। তরনাক নদীর ঢেউগুলো বুঝি একেকবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে - হে খোদা রহমান, আজকের সকালটা কেমন হবে?
নুরিয়েন বিছানাতে উঠে বসলো। কম্বলটা একপাশে সরিয়ে আড়মোড়া ভাঙছিল - তখনই তার চোখদুটো গিয়ে পড়লো - ঘরের কোণে রাখা টিনের বাক্সটার ওপর। বাক্সটার ওপর পড়ে আছে তার স্কুল ব্যাগ, আর দুটি কিতাব। একটা ফারসির, অন্যটা ইতিহাসের বই। কতদিন হয়ে গেলো নুরিয়েন তাদের পাতাটুকু উল্টে দেখেনি। দিন কোথায়? মাস কেটে গেছে... চার মাস...
দু বছরের ওপর হয়ে গেলো সে স্কুলে যাচ্ছে না। শুধু সেই নয়, পূর্ব বা মধ্য আফগানিস্তানের কোনো মেয়েই স্কুলে যেতে পারে না। এদিকটা পাখতুনদের এলাকা। তালিবানী সর্দারদের ঘাঁটি। আরবীতে তালিব শব্দের অর্থ হোলো - ইচ্ছুক, অভিলাষী। কিন্তু তলিবানীদের নাম শুনলেই লোকে থত্থর করে কাঁপে। তাদের হুকুমে এ অঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। মাথা থেকে পা অব্দি বোরখা না প’রে তাদের বাইরে বেরুনোই বন্ধ। মেয়েদের কাজে কর্মে বেরুনোতেও নিষেধ। মেয়েদের তো দুরের কথা, ছেলেদের স্কুলেও বিজ্ঞান পড়ানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো স্কুলে ম্যাথও আর পড়ানো হয় না।
কতদিন হয়ে গেল - নাজ্মা টীচারের সাথে নুরিয়েনের দেখাটুকু হয়নি। নাজ্মা টীচার - তার কথা মনে পড়তেই
নুরিয়েনের চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে সেই হাসি খুশী মুখটা। নীল রঙের বোর্খার চোখের সামনের পর্দাটা তুলে চুপটি করে চলে আসতো আর এ পাড়ার একেকটা মেয়ের বাড়ি গিয়ে দরজা থেকে ডাক দিতো, ‘নুরিয়েন, তাড়াতাড়ি চলে আয়। আজ সাজীদার বাড়ি ক্লাস হবে। চ -!’
‘আরে - অ - নুরী -’
‘আম্মী, আসি -’
‘তোরা যেতে যেতে তো কলের জলই চলে যাবে রে। যা যা নিচের সড়ক থেকে জল ভরে নিয়ে আয়।’
মায়ের ডাক কানে যেতেই নুরিয়েন বাইরে বেরিয়ে পড়ে।
‘ওরে পিদর্কুখ্তে (পিতৃদাহ)! পর্দাটা তো করে নে। মুখটা ঢাক।’ মা নিজের গায়ের উড়নীটা মেয়ের দিকে ছুঁড়ে দিল।
থমকে দাঁড়ায় কিশোরী নুরিয়েন। স্মৃতির ভারে পাদুটো তার অনড়। রক্ষে করো আল্লা! এই তো গতমাসে সাকিনা ফুফু নিজের শ্বাশুড়ীর সাথে গিয়েছিল সব্জি কিনতে। তা, সে সব্জিগুলো টাটকা না বাসি, আলু পেয়াজগুলোতে দাগ আছে কিনা - তা দেখার জন্য দুজনে মুখের সামনে থেকে বোরখার ঢাকাটা তুলে দিয়েছিল। খোদায় মালুম কখন তা তালিবানী সেপাইদের নজরে পড়ে। অমনি ছুটে এসে তারা রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাদের মারতে শুরু করলো। দুজনে মাটিতে পড়ে যেতেই - তাদের ওপর চালাতে লাগলো বুটসুদ্ধ লাথি। সত্তর বছরের বুড়ীটার ওপরেও কারো এতটুকু করুণা হলো না। দুজনেই হাত তুলে কাকুতি মিনতি করছিল, ‘মাফ করে দে বেটা!’ ‘খোদার দোহাই, আর মেরো না ভাইজান!’
২
এমন জল্লাদেরা কি কখনো সাচ্চা মোমিন্(ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান) হতে পারে? প্লাস্টিকের লম্বামুখো সোরাইটা হাতে নিয়ে গলির মাথায় কলের কাছে চলে এসেছে নুরিয়েন। আর একাধ ঘন্টার মধ্যে কলের জল চলে যাবে। বড় রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই নুরিয়েনের মনে হোলো - আজকের ব্যাপার স্যাপার যেন একটু অন্যরকম। যেদিন থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের সিংহাসন গেছে তালিবানী গোষ্ঠীর মুঠোর মধ্যে, সেদিন থেকে ব্যাটাছেলেরা মাথায় কালো পাগড়িই বেঁধে
থাকতো। আর মেয়েমানুষদের বাইরে বেরুনোর তো কোনো প্রশ্নই ছিল না। যখন আফজলী বু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তখন ডাক্তার কোথায়? হাসপাতাল থেকে সমস্ত লেডী ডাক্তারদের তো দূর করে দেয়া হয়েছিল। আর ব্যাটাছেলে ডাক্তার যদি রোগিনীদের দেখে, তাহলে তো দুজনেরই কপালে নাচতো অকরুণ শাস্তি। মেয়েদের স্কুল বন্ধ। কাজে বেরুনো বন্ধ। তাই না আফজলী বু’কে দুই সপ্তাহ ধরে পেটের ব্যাথায় ছটফট করতে হয়েছিল .......
ইস্লামের নামে প্রায় প্রত্যহই কোনো না কোনো ‘ফতোআ’(নির্দেশ) জারী করা হোতো। কিন্তু এইমাত্র সড়কের ওপর দিয়ে যে ট্রাকটা চলে গেলো - তাতে যে সেপাইরা বসে ছিল - তাদের মাথায় তো খয়েরী রঙের উলের টুপি। অনেকেরই গালে দাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। নুরী ভাবছিল ...ব্যাপারটা কি?
কলের মুখে জল পড়ছে-কল কল খল...
সুরাহী তাই বলছে ভ’রে নে ঘরে চল...
স্মৃতিও যেন কানে কানে কথা কয় ...
নাজ্মা টীচার কত’না অপমান, কত’না কষ্ট সহ্য করে তাদের পড়াতে ছুটে আসতো। শেষ পর্যন্ত এই পড়ানোর জন্যই তো... হে রহমান খোদা, আমাদের কসুর মাফ কোরো! আমরা সবাই নাজ্মা টীচারের কাছে অপরাধী। যে সময়ে সে বিপদের দরিয়ায় ডুবে যাচ্ছিল, আমাদের কেউ তার হাত ধরে তাকে বাঁচাবার চেষ্টাটুকু করেনি। আমার আব্বা বা পাড়ার অন্য কারো হিম্মৎটুকু হোলোনা যে এ ইবলিশ(শয়তান)দের সামনে রুখে দাঁড়ায়। হে আল্লা, এ অপরাধ ক্ষমা কোরো।
একদিন পশ্তোর ক্লাস নেবার সময় নাজ্মা ম্যাডাম কবি উমর করজাইয়ের কবিতা শোনাচ্ছিল, ‘দেখো কোরানের আয়াতগুলোকে কেমন করে কবিতায় ঢেলে সাজিয়েছে।- সত্যের বিজয় হবে, মিথ্যা হেরে যায়/ সূর্য এলে অন্ধকার মুখ্টি লুকায়!’
আরেকদিন ইতিহাস পড়াবার সময় বলছিল, ‘আমাদের আফগানিস্তানের ইতিহাসও বিচিত্র। যারা বেমিয়ানের অত বিশাল বুদ্ধ প্রতিমাটাকে বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তারা কখনো ভেবে দেখেছে - এদেশে মৌর্য, বৌদ্ধ, শক, কুষাণ - এবং সবশেষে ইসলাম -কার প্রভাব নেই? সারা পৃথিবী কোথা থেকে কোথায় পৌছে গেছে, আর এখানে? আমরা শুধু এটা ওটা তুচ্ছ জিগির তুলে একে অপরের রক্তপাত করে চলেছি।’
ক্লাস চলতো খুবই সন্তর্পণে। কথা যা হতো ফিসফিস করে। বাইরে বড় রাস্তায় তালিবানী সৈনিকদের বুটের আওয়াজ শোনা যেতো। ওরা কাছাকাছি এলেই নাজ্মা চুপ করে যেতেন। বাকি মেয়েরা শ্বাসটুকু বন্ধ করে বসে
থাকতো। যদি ওরা নিশ্বাস নেবার শব্দটাও শুনে ফেলে? সবাই মনে মনে দোয়া চাইতো - আল্লা, এদের এখান থেকে ভাগাও। তবেই তো আমরা পড়তে পারবো।
বহুযুগ আগে আফগানিস্তানের আমীর আমানুল্লা এবং তার বিদুষী বেগম সুরৈয়া কাবুলে মেয়েদের স্কুল খুলেছিলেন। সে সময় মেয়েদের হিজাব বা বোরখা পড়াও বারণ ছিল। রেগেমেগে মোল্লারা ভাগালো তাকে। তখন ডাকাত বচ্চাএ শকাও আমীর হয়ে তখ্তে আসীন হল। আর স্কুল হোলো বন্ধ।
ক্লাস চলার মাঝেই হয়ত ফৌজীদের ট্রাক চলে গেলো। কেঁপে উঠলো পাথুরে দেয়াল।
‘সাজিদা, একটু উকি মেরে দেখতো। ফৌজীরা আছে না বিদেয় হয়েছে।’ ক্লাস শেষ হতে হতে নাজ্মা বলে উঠতো।
উড়নী দিয়ে ভালো করে ‘পর্দা’ করে সাজিদা চুপি চুপি বাইরে বেরিয়ে দেখে আসতো, ‘ম্যাডাম, কেউ নেই।’
৩
‘আরে আরে - সব্বাই একসাথে বেরুস না। এক এক করে বাড়ি যা। বইগুলোকে বোরখার ভেতর লুকিয়ে নে না।’ একে একে মেয়েগুলোকে রওনা করে দিয়ে, তবে নাজ্মা টীচার নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়াতো।
এই তো গত বছরেই...
নুরিয়েনের বড়ভাই য়ুনুস ‘হিসাব’ (ম্যাথ)এর পরীক্ষার শেষে পেপার হাতে বাড়ি ফিরলো। পেপার দেখে সবাই
হতবাক।
‘ভাইজান, হিসাবের পেপারটা একটু দেখি না -।’
‘এই নে পড়ে দেখ, তোরও মাথা ঘুরে যাবে। নে এই সওয়ালটা পড়,’ - ‘এক তালিবানী সৈনিকের বন্দুকে ছ’টা গুলি আছে। যদি সে এক একটা গুলি দিয়ে দুটো কম্যুনিস্ট আর তিনটে কাফিরের প্রাণ নিলো, তাহলে তার রাইফেলে আর কটা গুলি বেঁচে রইল?
‘য়া আল্লাহ! এটা কোন্ হিসাবের সওয়াল!’ আম্মা চাই(চা) করতে করতে উড়নীটা চোখের ওপর চেপে ধরে।
আব্বা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, ‘ওয়াল্লাহ্ ও বিল্লাহ! এ কি ঘটে চলেছে? এ কোন ইবলিশের আওলাদকে তুমি জিব্রাইলের দেবদূত) মুখোশ পরিয়ে পাঠালে?’
‘ভাইজান, এ পেপারটা আজ নাজ্মা টীচারকে দেখাবো, কেমন?’
প্রশ্নপত্রে চোখ বুলোতে বুলোতে নাজ্মার বুক ফেটে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, ‘সরলমনা বাচ্চাদের মনে বিষ ভরে দেবার কত না ফন্দী।’
এ ভাবেই সমস্ত চলছিল। কিছুদিন ক্লাস চলত। কিছুদিন বন্ধ। আবার দু চার দিন বোর্খার নিচে বই লুকিয়ে ছুটোছুটি। ফের বন্ধ। এর মধ্যেই সুদূর আমেরিকার না জানি কোন দুটো ইমারৎ হলো ধুলিস্যাৎ। আল কায়েদার
আতংকবাদীরা প্লেন উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সে ইমারতে মেরেছিল মোক্ষম ধাক্কা। যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে। ইমারৎ ভাঙলো সাত সাগরের পারে, কিন্তু তার খেসারৎ দিতে দিতে আফগানিস্তানের জনতার নাভিশ্বাস উঠতে লাগলো। সে সময়েই একদিন দুপুরের জোহারের নামাজের পর নুরীদের বাড়ির পিছনের হাতায় সব মেয়েরা এসে জড়ো হয়েছিল। নাজ্মা পড়াচ্ছিলেন। ক্লাস শেষ হতেই তিনি নুরীকে ডাকলেন, ‘একটু গলিতে যেয়ে দেখ, কেউ আছে কিনা। সাবধানে যাস।’
হুট করে একটা বোরখা তুলে নিয়ে পরতে পরতে নুরিয়েন বেরিয়ে গেলো। বোরখাটা ছিল সাজিদার।
একটু বাদেই গলির সিঁড়ির নিচ থেকে সে ফিসফিস করে বলে উঠলো, ‘ম্যাডাম, কেউ নেই। হুসৈনী, সাজিদা,
সব নেমে আয়। তাড়াতাড়ি।’
আপন গর্ত থেকে বেরুবার সময়ে খরগোশেরা যেভাবে ইতিউতি দেখে নেয় যে আশেপাশে কোনো শেয়াল ওৎ পেতে আছে কিনা-সেভাবেই এদিক ওদিক দেখতে দেখতে মেয়েগুলো পথে নেমে এলো। তাড়াহুড়োতে সাজিদা ভুলেই গেলো যে তার গায়ে বোরখাটাই নেই। বইগুলোকে বুকে চেপে নিজেদের গলির মুখে পৌছনো মাত্রই দেখতে পেলো বাব্লা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে তিনটে তালিবানী ফৌজী -
‘আ্যাই ছুঁড়ি, থাম। বজ্জাৎ, বেশরম্। মুখ না ঢেকে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস?’ লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো তাদেরই একজন।
ভয়ে আতংকে সাজিদা পাগলের মত উন্মত্ত হয়ে ছুটতে লাগলো। তাতে হল আরো ঘৃতাহুতি।
‘অ্যাই ছুঁড়ি, থাম বলছি।’ বলতে বলতে অন্যজন নিজের হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে মারলো - সাজিদার পায়ে - খট্টাস্...
‘আম্মা গো -!’ সাজিদা হুমড়ি খেয়ে পথের ওপর পড়ে গেলো। এবড়ো খেবড়ো অসমতল রাস্তাতে ছড়িয়ে
গেল হাতের বইগুলো...
‘আরে ডাইনী, এ কিতাবগুলো নিয়ে তুই কি করছিলি? পড়ছিলি? এত সাহস? পাপিনী!
৪
তুই জজ ম্যাজিস্টেট হবি?’ বলতে বলতে তিনটে নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো অভাগিনী মেয়েটার ওপর। চলতে লাগলো লাথে আর ঘুঁসি...
‘মেরো না... আর মেরো না।’ সাজিদা ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
আর তখনই ছুটতে ছুটতে নাজ্মা এসে দাঁড়িয়েছিল সেখানে, ‘থামো। এ কিতাবগুলো ওর নয়। আমার। দোহাই ওকে মেরো না।’
এক মুহুর্ত আগেই যখন ওরা তিনজন মিলে সাজিদাকে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত মেরে যাচ্ছিল, গলির মোড় থেকে তা দেখতে পেয়ে দুটি মেয়ে ছুটতে ছুটতে নুরিয়েনের বাড়ি ফিরে গেছিল।
নাজমা ওদের দেখতে পেয়েই উৎকণ্ঠায় এসেছিল ছুটে, ‘কি ব্যাপার? কি হয়েছে? তোরা হাঁপাচ্ছিস কেন?
‘ওখানে-ঐ -ওরা।’ মেয়েদুটি থত্থর করে কাঁপছিল। কথাটুকু শেষ করতে পারেনি।
‘আরে হয়েছেটা কি, বলবি?’ নাজ্মার বুকটাও ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো। মনের আকাশে উকি দিয়ে গেল
অশনি সংকেত... ততক্ষণে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে নুরিয়েন সব কিছু দেখে নিয়েছে, ‘টীচার, তিন তিনটে তালিবানী সৈনিক মিলে সাজিদাকে পেটাচ্ছে।’
‘হায় আল্লা!’ অস্ফুট চীৎকার করতে করতে নাজ্মা একছুটে বেরিয়ে গেছিল,আর এ ফৌজীদের সামনে গিয়ে জোর গলায় বলে উঠেছিল, ‘এ কিতাবগুলো আমার !’
ওদিকে বাড়িতে কাঁদতে কাঁদতে নুরিয়েন ছুটোছুঁটি করছে, ‘আব্বু বাঁচাও! বাইরে গিয়ে দেখো। সাজিদাকে ওরা বোধহয় মেরেই ফেল্ল -।’
‘কি হোলো কি -?’ বলতে বলতে ওর আম্মী দরজার কাছটাতে এসে দাঁড়িয়েছিল।
তার আবুও এগিয়ে গিয়েছিল গলির মুখে। কিন্তু কারো এতটুকু সাহস হোলো না যে এ অভাগিনীকে নেকড়েগুলোর কবল থেকে রক্ষা করে। মাটির মূর্তির মতই সবাই রইল দাঁড়িয়ে...
‘থামো! এ কেতাবগুলো আমার। ওকে মেরো না।’ বলতে বলত নাজ্মা সাজিদাকে আড়াল করে ঝাঁপিয়ে পড়লো- ঠিক যেভাবে মা পায়রা বাজের কবল থেকে নিজের শাবকদের রক্ষা করে। কবুতরের ডানার মতই নাজমা দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিল। আর তার বুকের নিচে রইল সাজিদা .....
‘আচ্ছা শয়তানী! এ তোরই কারসাজি?’ নাজ্মার পিঠে পড়তে লাগলো তিনটে বুটের লাথি, ‘মাস্টারনী হয়েছিস?’
‘কাফির। এ তো হিন্মৎ! তালিবানের বারণ করা সত্ত্বেও মেয়েদের পড়াচ্ছিলি?’ বলতে বলতে একজন সজোরে নাজমার বাঁ পায়ের ওপরে লাখি মারলো। এমন একটা শব্দ হলো যে নুরিয়েন আর তার বাপ মা সবাই উঠলো কেঁপে।
ককিয়ে উঠলো নাজ্মা। বোধহয় ওর পায়ের হাড়টাই গেছে ভেঙে ......
তৃতীয় সৈনিকটা রাইফেলের বাট দিয়ে তার মাথায় পিঠে মেরে যাচ্ছিল, ‘ইস্লামের বিরুদ্ধে যাবি? এত বড়
দুঃসাহস! এই নে তার কীমৎ -! আর তোর কিতাবের নিকুচি করেছে।’ দারুণ আক্রোশে সে জুতোর তলে বইগুলোকে দলে দিতে লাগলো।
‘না-! কিতাবগুলোকে নষ্ট কোরোনা।’ অবস্থাতেও নাজ্মা হাত বাড়িয়ে বইগুলোকে বুকের নিচে টেনে নেবার চেষ্টা করতে থাকে।
নুরী চীৎকার করছিল, ‘আব্দু বাঁচাও! নাজ্মা টীচারকে বাঁচাও -?’
কিন্তু তার বাপ চুপচাপ শুধু দাঁড়িয়েছিল। পাড়ার অন্যান্য ব্যাটাছেলেরাও বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু আজ সকলেই কাপুরুষ। প্রতিবাদ করার এতটুকু সৎসাহস কারো মধ্যেই ছিল না। কারণ - পরিণাম যে সাংঘাতিক!
দেখতে দেখতে কালাৎ এ ঘিলজাই শহরের এই গলিটা লাল রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো। অদূরে দাঁড়ানো চীড়, দেবদারু গাছের পাতাগুলো নিষ্কম্প হয়ে চেয়ে রইলো...
৫
নাজ্মা মারতে মারতে ক্লান্ত হয়েই বোধহয় এ তিন জল্লাদ এখান থেকে চলে গেলো। ওরা চোখের আড়াল হতেই নুরিয়েনের মা এলো দৌড়ে। নাজমাকে ধরে দাঁড় করাবার চেষ্টা করতে লাগলো, ‘বাড়ি যেতে পারবে?’
‘না - আহ্। আমার পা-টা বোধহয় ভেঙেই গেছে। আমি তো দাঁড়াতেও পাচ্ছি না। বাড়ি ফিরবো কি করে?’
সাজিদা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। তার আঘাত গুরুতর হলেও, হাড়গোড় কিছু ভাঙেনি।
সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো-নাজ্মাকে কি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়? শেষে নুরিয়েনের আব্বা আম্মী এবং আরো দু একজন মিলে তাকে একটা গাধায় টানা গাড়ীতে শুইয়ে হাসপাতালের পথে রওনা দিল। ডাক্তারকে তো পর্দার আড়াল থেকেই রোগিনীকে দেখতে হলো। ঘাগুলোতে পটি বাঁধার পর কোনোরকমে তার বাঁ পায়ে প্লাস্টরিং করা হলো।
ওরা যখন বাড়ি ফিরছে, তখন মসজিদে মসজিদে বিকেলের অসরের নামাজ শেষ হয়েছে। নুরিয়েনের মনের দরজায় ক্রমাগত যেন একটাই প্রশ্ন কড়া নেড়ে চলেছে -আমার আব্বা বা আর কেউ নাজ্মা টীচারকে সাহায্য করার জন্য একটুও এগিয়ে এলো না কেন? ম্যাডাম তো আমাদেরকেই পড়াতে আসতো। আমাদের জন্যই তাকে এ জল্লাদগুলোর হাতে নির্যাতন ভোগ করতে হলো। আমরা তার প্রতিদানে কি দিলাম? ভাবনাগুলো এ ছোট্ট মেয়েটার বুকের ভেতরটা যেন কুরে কুরে খেতে লাগলো। হঠাৎই আম্মার বোরখাটায় টান মেরে নুরিয়েন বলে উঠলো, ‘আম্মী, আমরা সবাই এত ভীতু কেন?’
নাজ্মা টীচার তাদেরকে হাসান হোসেনের কাহিনী শুনিয়েছিলেন। ইসলামের প্রচারের জন্য কিভাবে দুই ভাই কর্বলার ময়দানে শহীদ হয়েছিল। মনে মনে সে নিজেকে, নিজের আব্বু আম্মীকে - পাড়ার সব্বাইকে ধিক্কার দিতে লাগলো, ‘আমরাই সেই হাসান হুসেনের সন্তান? ছি!’
ওর মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। আর কখনো নাজ্মা ম্যাডামের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে?
কলের থেকে জল ভরে নুরিয়েন বাড়িতে রেখে এলো। প্রত্যহ এইভাবে ওকে কয়েকবার বাড়ি থেকে রাস্তার কলঅব্দি দৌড়তে হয়। আজকে তো আবার কয়েকটা মেয়ে তর্নাক নদী থেকেই জল ভরতে গেছে। ইদানীং তো মেয়েরা দিনের বেলাতেও নদীর দিকে যেতে ভয় পেতো। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তারাই সব কল কল করছিল, ‘তর্নাকের ধারে আজ বাজার বসে গেছে রে! কান্দাহারের আঙুর বিক্রী হচ্ছে।’ ওদের কথা কানে যেতেই নুরিয়েন ভাবতে লাগলো - আজ ব্যাপারখানা কি?
আর আজ বার বার নাজ্মা টীচারের কথাই বা মনে পড়ছে কেন? চার মাস হয়ে গেলো তার সাথে শেষ দেখা
হয়েছে৷ কেমন আছে এখন? চলা ফেরা করতে পারছে? আমরা তো কেউ কখনো তার খোঁজটুকুও নিতে যাইনি। কোন মুখে যেতামই বা? সেদিনের কথা মনে পড়তেই নুরীর দুচোখে যেন কর্নাকের জল উপ্চে ওঠে। নাজ্মা ম্যাডামের সারা অঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল - আর আমরা সবাই তা চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম?
ঠক্...ঠক্...ঠক...
কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। নুরিয়েন চমকে ওঠে, ‘কে -?’
‘ফট করে দরজা খুলে দিস নে যেন।’ আম্মা সাবধান করে দেয়, ‘আগে জিজ্ঞেস করে নে -কে?’
খানিক্ষণ টুপ করে থেকে নুরী আবার শুধোয়, ‘কে?’
‘আরে নুরীয়েন, খুলেই দেখ না। আমি রে - আমি।’
ঐ তো সেই চেনা স্বর। তবু কেন মনে হয় অনেক দূর - সেই হিন্দুকুশের পার থেকে ভেসে আসছে! পা দুটো যে নড়তে চায় না। তবু মন পঙ্খী পাখ্না মেলে উড়ে যেতে চায় ত্বরা....
দরজাটা খুলে নুরিয়েন চুপটি করে চেয়ে রইল। সেই হাসি হাসি মুখ। হাতে একটা লাঠি। বোরখার ওপরে
৬
কাঁধ থেকে একটা থলে ঝুলছে। আর তা থেকে উকি মারছে অনেকগুলো কিতাব...
কে জানে কেন নুরিয়েন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেল্ল, ‘আমাদের মাফ করে দিন, ম্যাডাম।’
‘পাগলী মেয়ে, শুধুই কাঁদবি? শুধোবিনে যে আমি কেমন আছি?’ নাজ্মা টীচার তার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
‘হম্শিরা(বোনকে সম্বোধন), আপনার পা’টা কেমন আছে,’ নুরিয়েনের আব্বা মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো।
‘সব ঠিক আছে। আল্লার লাখো মেহেরবানী যে আপনারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন।’
‘আমরা আর কিই বা করেছিলাম, হম্্শিরা ? আমরা তো ভয়েই আধমরা হয়েছিলাম। আপনাকে রক্ষা করতেও
পারিনি। আমরা তো সবাই এক একটা কাপুরুষ।’
‘ভাইজান, এই ভয়টার সাথে পাঞ্জা লড়ার জন্যই তো দরকার কিতাবের। এই লড়াইতে একমাত্র কেতাবই আমাদের হাতিয়ার। এখন তো তালিবানী শাসকদের সিংহাসনও উল্টে গেছে। তাই তো আজ সবাই একটু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পাচ্ছে।’
‘তাই নাকি?’ নুরিয়েন ম্যাডামের হাতদুটো ধরে নেয়।
‘দেখিসনি পাকুলা টুপি মাথায় দিয়ে উত্তরী জোটের সৈনিকেরা সব ঘোরাফেরা করছে। তা নুরী, তাহলে আজ
থেকে আবার ক্লাস শুরু -?’
ম্যাডামের বুকের মধ্যে মুখখানি গুঁজে দিয়ে নুরিয়েন দাঁড়িয়ে রইল। মুখে একটাও কথা নেই। ছোট্ট নুরী নাজ্মার হাত ধরে নিল। চুপচাপ। কিতাবের ঝোলাটা তুলে নিলো নিজের কাঁধে।
তারপর দুজনেই বেরিয়ে পড়লো কালাৎ ই ঘিলজাইয়ের পথে - অন্যান্য মেয়েদের ডাকতে...
পথের দুধারে দাঁড়ানো চীড়, দেবদার আর আপেল গাছের পাতাগুলো হাওয়ায় দোল খেতে খেতে তাদের ডাকতে থাকে - আয়... আয়... আয়....