জ্যৈষ্ঠের চড়া গরমে সব যখন ঝলসে যাচ্ছে, তেমন এক নির্জন দুপুরের সেই ঘটনাটাই আজ বলা যাক।
দুপুরে ভরপেট খেয়ে কবি মহেন্দ্রমোহন মাঝি নিজের লেখবার ঘরের সোফায় আধশোয়া হলেন একটু বিশ্রাম নেবেন বলে। গরমের ক্লান্তি আর ভাতঘুমের আমেজ মিলেমিশে যখন চোখটা সবে ঢুলুঢুলু হয়ে আসছে; ঠিক তখনই এই ঘটনার ঘনঘটা! বিনা অনুমতিতেই ঘরে অযাচিত অতিথি হাজির!
—“ও মশাই কি হলো ঘুমোলেন নাকি! কখন থেকে কানের ছিদ্র তাক করে পিইইইইন পিইইইইন করছি আপনার হুঁশই নেই! বলছিলাম যে- এই অবেলায় ঘুমোচ্ছেন নাকি! আপনি তো কবিতা টবিতা লেখেন শুনি, তা আমাদের অভাগা মশককুলের কথা লিখেও তো কিছুটা আমাদের মনোকষ্ট লাঘব করতে পারেন নাকি! আসলে কেউ কখনো তো ভাবেননি আমাদের মশাদের কথা। আপনাদের মতো নরম মনের কবি মানুষরাও যদি মুখ ফিরিয়ে থাকেন, আমরাই বা যাই কোথায়! ....আর সেভাবে দেখলে আমরাও এই মশককুল সমবেত হয়ে জীবনযুদ্ধে লড়ছি তো! তবে কিনা আমাদের লড়াইটা কিছু অত্যাচারী মানুষদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে! শুনুন, মানুষ কুলের বাবামশাইরা আর যাই করুন, সাইজে ছোট বলে আমাদের অবহেলা আর গাল পারাটা বন্ধ করুন দেখি!... এক শুঁড়িখানায় সেদিন শুনি এক মাতাল আরেক মাতালকে বলছে-‘বাগে পেলে তোকে মশার মতো টিপে মারবো!’ ....আচ্ছা, ভাবুন দেখি আপনারা না গান্ধীজীর দেশের মানুষ, এসব হিংসা আপনাদের মানায়? আর তাছাড়া মশা বলে কি আমাদের মন নেই! যাক বাদ দিন।”
একটু থেমে বরিষ্ঠ রাশভারী মশকপ্রবরটি বলতে লাগল - “ও মশাই জানেন তো, এই আজই আমাদের প্রাক বর্ষাকালীন জমায়েত করে ফিরছি। আমি পরিবারের সিনিয়র সদস্য তো, তাই আগামী প্রজন্মকে রাস্তা দেখানোর দায়িত্ব টা তো থাকেই। তাই বয়স হলেও এসব মিটিং মিছিলে যাওয়া আমার বাদ নেই।.....এই দেখুন না! এই গরমের হাঁসফাঁস পেরোতে পেরোতে আর মানুষের দমাদ্দম চড় চাপড়ে চাপা পড়তে পড়তে আমাদের মশক বংশের অনেক সদস্যকেই তো আমরা হারালাম। তার ওপর কিসব ব্লিচিং ডি. ডি.টি-র অত্যাচার তো ছিলোই। এখন আবার কাল -পিলা-নীলা হীট দিয়ে আমাদের মশককুলকে অলআউট করবে বলে মানুষজন উঠে পড়ে লেগেছে। তা বলে কি আমরা দমে যাবো নাকি! কক্ষণো না! বর্ষার প্রাক্কালে এই মিটিং টা তো সেজন্যই ডাকা। বলতে পারেন জীবনশৈলী নিয়ে একটু আধুনিক হয়ে ওঠা। আসলে এখন তো সব ঢাকা নর্দমা। রাস্তায় জঞ্জালের স্তূপ ও কমে আসছে পলিটিক্যাল ভোটাভুটির চাপে। ফলে আমাদেরও বদলাতে হচ্ছে আপনাদের সাথে সাথে! যেমন বর্ষার জলটি পড়লেই আমাদের মহিলা মশকীরা দু-একটা পচা ডোবা পুকুরের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুঁজতে বেরোবে কোথায় কার বাড়ির ছাদের পুরনো ভাঙা টব-শিশি-বোতল, কিম্বা বাগানের ভাঙা বালতি-ফুলদানির ভেতর বৃষ্টির জল গোপনে জমছে। আর টুক করে সেখানে ডিম পেড়ে আমাদের আগামী প্রজন্মের আসন্ন জন্মসংবাদ সুনিশ্চিত করবে! একটু খিকখিক করে হেসে মশকপ্রবরটি বলে চললো - “দেখুন মশাই, নিজেদের মশক কুলের সাফল্যের কথা বলতেও গর্ব হয়। আমাদের মধ্যে আবার ওই তিন শরিক বুঝলেন - কিউলেক্স, অ্যানোফিলিস আর এডিস। তিনজনেই নিজ গুণে বিশেষ দক্ষতায় গুণী ও সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রথমজন গোদ বিশেষজ্ঞ। পুরো ম্যাজিশিয়ানের মতো, এক কামড়েই মানুষের আঙুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানিয়ে দিতে পারে। অবশ্য যুগ পাল্টাচ্ছে জলবায়ু পাল্টাচ্ছে, আর তারও বয়স বাড়ছে সেজন্য এখন আর বাইরে বাইরে ম্যাজিক সে বেশি দেখায় না। দ্বিতীয়জনের কথা বলতে গেলে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। ম্যালেরিয়া না সাওয়ারিয়া নামে কি একটা জ্বর দিয়ে মানুষের গা গরম করে শীতকাল ছাড়াও মানুষকে অষ্টপ্রহর ঠকাঠক কাঁপিয়ে দিতে পারে। আর শেষজন তো একদম শৌখিন। কোনো নোংরা ঘাঁটেনা। এমনকি ওদের ঘরের মহিলারাও তাদের গর্ভকালে ডিম পারবে কোনো নর্দমা আবর্জনায় নয়, - একদম ঝকঝকে জমা জলে! ওর হলো গিয়ে ডাবল পিএইচডি (পরাণ হাতের ডুগডুগি) - ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া দুটোতেই একদম চোস্ত! যাক্ সেকথা । ....আসলে খবরে শুনলাম আপনারা মানে এই মানুষরা মিলে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। জনসংখ্যায় একদম টপ। আর সেই সাথে বেকারত্ব-মুদ্রাস্ফীতি-দুর্নীতিও তো বাড়ছে টপাটপ। তাই এতকাল মানুষের সাথে ওঠবোস, শোওয়াখাওয়া তো করলাম, যদি কিছু সাহায্য লাগে, তাই বলে গেলাম আরকি! আমাদের চাহিদাও তো যৎসামান্য রক্ত মাত্র! আচ্ছা চলি তাহলে। আর হ্যাঁ নাতি পুতি হলে আবার আপনাদের সাথে এসে দেখা করে যাব’খন!”
.......................
কবি মহেন্দ্রমোহন দুপুরের বিগড়ে যাওয়া ঘুম চোখ রগড়ে নিয়ে টেবিলের পাশে বসে নোটবুকের পাতায় কালকে জমা দেওয়ার লেখার প্লট টা নোট করতে লাগলো! মনে কেবল একটা খটকা রয়ে গেলো - দীর্ঘ কবি জীবনের সব লেখা তো প্রকৃতি গাছ নদী মানুষের জন্য লেখা হলো, এরপর কি তবে মশককুলের জীবন যুদ্ধের কথা সত্যিই লিখতে বসবে মহেন্দ্রমোহন! তেমন কিছু হলে সেই সংবাদ স্বয়ং কবি মহেন্দ্রমোহন মাঝি নিজে আপনাদের সক্কলকে জানান দেবেন। উনি নিজে কথা দিয়েছেন যে!