‘বিশ্ববীনা রবে বিশ্বজন মোহিছে,
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সংগীত মধুরিমা
নিত্য নৃত্য রস ভঙ্গীমা’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের মনন ও চিন্তনকে সদা সমৃদ্ধ করছেন। প্রকৃতির অমোঘ ও প্রকৃতির রূপমাধুরীর অবিরল, অবিচ্ছিন্ন প্রকাশ ঘটেছে তার লেখনীতে। আজীবন প্রকৃতি ও বসুন্ধরাকে ভালোবেসেছেন এবং তাকে রক্ষা করতে নিজেকে নিয়ত নিয়োজিত রেখেছেন। শহর ছেড়ে প্রকৃতির নিরিবিলি কোলে আশ্রয় নিয়েছেন, তৈরি করেছেন মনের শান্তি ও প্রাণের আরামের শান্তিনিকেতন। পলাশ, শিমুল এবং নানান তরুলতায় আবৃত ছায়াসুনিবিড় এই শান্তিনিকেতনে কবি একের পর এক সৃষ্টি করতে লাগলেন তার অমর সৃষ্টি। আদি কবি বাল্মিকী যেমন তীর গাঁথা এক পাখিকে দেখে আকুল হয়ে প্রথম রচনা করেছিলেন অপূর্ব এক লালিত্যময় সংস্কৃত শ্লোক। দস্যুতা ছেড়ে হয়ে উঠলেন রামায়ণের রচয়িতা মহাকবি বাল্মিকী। ঠিক কিছুটা তেমনই 1894 সালে পদ্মা নদীর বুকে বজরায় থাকাকালীন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে এক মুরগিকে বাঁচিয়ে তিনি আমৃত্যু মাংস খাওয়া পরিত্যাগ করেন। পরে এক চিঠিতে তিনি লেখেন ‘পৃথিবীতে অনেক কাজ আছে যার দূষণীয়তা মানুষের স্বহস্তে, গড়া …………….. আমার বোধ হয় সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠ ধর্ম সর্ব জীবে দয়া’। এই একটি ঘটনা বা একটি চিঠি দেখলেই বোঝা যায় কবিগুরুর পশুপ্রেম কত গভীর, কত নিবিড়। বাংলার ছোট-বড় পশুপাখিদের তিনি নিখুঁতভাবে লক্ষ্য করে তার বর্ণনা দিয়েছেন বিভিন্ন কবিতায়, গানে, প্রবন্ধে ও নাটকে ইত্যাদি।
‘বনে থাকে বাঘ,
গাছে থাকে পাখি।
জলে থাকে মাছ।
ডালে আছে ফল।
পাখি ফল খায়।
পাখা মেলে উড়ে।’
সহজ পাঠের এই সহজ কবিতা আমাদের ভালবাসতে শেখায় প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণীদেরকে। ‘তীরে কলমি শাক ও হেলঞ্চ’কেও আমাদের চেনান ও ভালবাসতে শেখান রবি ঠাকুর, অর্থাৎ কোন জিনিস তুচ্ছ নয়, হেয় নয়। আজ বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে মানুষের চিন্তার সীমা নেই। হাজার বক্তব্য, সেমিনার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি চলছে সর্বদা। অথচ আজ থেকে এতো বছর পূর্বেও রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব উষ্ণায়ন ও তার কারণ নিয়ে লিখলেন অতি সরল ভাবে কিন্তু সুনির্দিষ্ট পথে। ‘পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় লোভ বেড়ে উঠল মানুষের’। ‘নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে দিতে লাগল নগ্ন করে। তাতে তার বাতাসকে করতে লাগল উত্তপ্ত, ………. অরন্যের আশ্রয় হারা আর্যাবর্ত আজ তাই খরতাপে দুঃসহ’। পৃথিবীর বর্তমান সংকটের কারণ যে বন ধ্বংস তা তিনি স্পষ্ট করে বললেন তার ‘অরণ্য দেবতা’য়। বললেন ‘সেই অরণ্য নষ্ট হওয়ায় এখন বিপদ আসন্ন’। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও তিনি বলেছেন, ‘আবার আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বরযাত্রী বনরক্ষীকে’। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে তিনি বছর বছর পালন করতেন ‘বৃক্ষরোপণ’ ও ‘হলকর্ষণ: অনুষ্ঠান। ‘বৃক্ষরোপণ’ অনুষ্ঠান সম্বন্ধে তিনি বললেন ‘ধরণীর প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য, তার ক্ষত বেদনা নিবারণের জন্য আমাদের বৃক্ষরোপনের এই আয়োজন। কামনা করি এই অনুষ্ঠানের ফলে চারিদিকে তরুছায়া বিস্তীর্ণ হোক, ফলে এই পরিবেশ শোভিত আনন্দিত হোক’। ‘হলকর্ষণ’ অনুষ্ঠানটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর উদ্দেশ্য হল অবহেলিত গ্রাম, গ্রামবাসী ও তাদের প্রধান জীবিকা কৃষির সাথে সর্বসাধারণের যোগ স্থাপন’। তিনি বললেন ‘হলকর্ষণ আমাদের প্রয়োজন অন্নের জন্য, শস্যের জন্য’। পরিবেশ দূষণ নিয়েও তিনি সচেতন ছিলেন। তিনি আক্ষেপের সাথে বলেছেন ‘এই দেশেই যে জল পবিত্র করে সে স্বয়ং অপবিত্র, পঙ্কবিলীন, যে করে আরোগ্যবিধান সেই আজ রোগের আকর’। নদীতে বাঁধ দেওয়া, নদীর গতিকে রুদ্ধ করে দেয়া ইত্যাদি নিয়ে তার তীব্র আপত্তি ছিল। তিনি ‘মুক্তধারা’ নাটকে বলেছেন ‘বালি-পাথর-জলের ষড়যন্ত্র ভেদ করে মানুষের বুদ্ধি হবে জয়ী এই ছিল উদ্দেশ্য। কোন চাষির কোন ভুট্টার ক্ষেত মারা যাবে সে কথা ভাববার সময় ছিল না’। আজ দিকে দিকে নদীবাঁধ তৈরি, বাস্তুতন্ত্র নষ্ট ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন চলছে, যা তিনি শুরু করেছেন বহু পূর্বে। তিনি সেই নাটকে বাঁধ ভেঙে নদীকে মুক্ত করেছেন, বইয়ে দিয়েছেন মুক্তধারা। আমরা তৃণকে অবজ্ঞা করি, অবহেলা করি ভাবি পরিবেশগত দিক থেকে এর কোনো গুরুত্ব নেই, কিন্তু তিনি বলেছেন ‘ঘাস যেন আপনার স্বাভাবিক নিষ্ফলতা লইয়া বিলাপ না করে-সে যেন স্মরণ করে যে, পৃথিবীর শুষ্ক ধূলিকে সে শ্যামলতার দ্বারা আচ্ছন্ন করিতেছে, রৌদ্রতাপকে সে চিরপ্রসন্ন স্নিগ্ধতার দ্বারা কোমল করিয়া লইতেছে’। বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে কেবল বৃক্ষরোপণ না, একটা আস্ত কৃত্রিম বনভূমি তৈরি করা যায়, তার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে বোলপুরের অদূরেই তৈরি হয় বল্লভপুর অভয়ারণ্য। সেই অরণ্য আজ পাখির কলরবে মুখরিত, অনেক প্রাণীর নির্ভয়ে বিচরণ করছে সেখানে। মানুষ যদি মাটির ঘরে বাস করে তা থাকে অনেক ঠান্ডা, স্বাভাবিক নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ বিরাজ করে সেখানে। ফলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয় অনেক। তাই তিনি মাটির ঘর তৈরি করেছেন নিজের মতো করে, তৈরি করেছেন তার প্রাণের প্রিয় ‘শ্যামলী’ অর্থাৎ মাটির সাথে আমরণ যোগাযোগ বজায় রাখেন তিনি। তাই রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি রক্ষার লড়াইয়ে আজও সামনের সারিতে বর্তমান, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, দিচ্ছেন ও ভবিষ্যতেও দেবেন এই আশা করি।