চরিত্র :
(শহরের ছেলেমেয়েরা)
রিচিক, পল্টন, শেখর, রায়ান, পৌলমী
(গ্রামের ছেলেমেয়েরা)
শ্যাম, সন্তু, মিনি, বিন্তি
নাটকের শুরুতে শারোদোৎসবের স্তোত্র পাঠের রেশ ধরে ঢাকের আওয়াজ... ঢাকের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে যেতে ট্রেন চলার শব্দ... এইরকম হবে যেন স্টেশনে ট্রেন এসে থামলো।
রিচিক : আরে এই এই এইতো সুভাষগ্রাম স্টেশন... পল্টন দ্যাখ্।
পল্টন : কই? এইটা স্টেশন? এত শুনশান! কিরে শেখর রায়ান?
শেখর : কিন্তু নামবো কেমন করে, প্ল্যাটফর্ম কই? কিরে রিচিক?
রায়ান : আরে হোয়ার পৌলমী? কী ইরেসপনসিবল মাইরি! এবার হোয়াট টু ডু?
রিচিক : বলেছিলাম তো, তোরাই বেকার আওয়াজ তুললি; এবার সপ্তমী থেকে নবমী পৌলমীদের গ্রামের বাড়িতে পূজো দেখবো...
পল্টন : লুক লুক পাবলিকরা লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে ট্রেন থেকে, মার জাম্প!
শেখর : ভেবেছিলাম নেতাজী নেতাজী একটা ফৌজিমার্কা ভাব থাকবে স্টেশনটার; পুরো ব্লান্ডার করলাম। অবশ্য ভাবাটাই অবান্তর; নেতাজীর নামে একশো বছরের এয়ারপোর্ট অথচ সেখানেই নেতাজী নেই; আছে গান্ধী।
রায়ান : লেট্স জাম্প ফ্রেইন্ডস্... ট্রেন বেশিক্ষণ স্টপেজ দেবেনা! আরে ঐ তো সাইকেলে মাঠ দিয়ে একটা মেয়ে...
রিচিক : কই? হ্যাঁ - থ্যাঙ্ক গড্... ঐ তো পৌলমী, লাগেজগুলো নিয়েছিস তো সবাই?
পল্টন : সকলে দেখে নেমে পড়... পৌলমী এই যে আমরা এখানে...
পৌলমী: তোরা একেবারে লাস্ট কমপারট্মেন্টে কেন উঠেছিস - আরে সিগন্যাল হ’য়ে গেছে... লাফিয়ে পড়...
রি/প : ঝপাঝপ্ মার লাফ্...
শে/রা : ওয়ান, টু, থ্রি... অ্যাঃ (ট্রেনের হর্ণ শোনা যায়... ট্রেন চলে যায়)
পৌলমী : খুব তালে নেমেছিস... এক্ষুণি বিশ্রামপুরে চলে যেতিস...
রিচিক : আরে ঐ তো প্ল্যাটফর্ম... কী ছোটো... দূর... কোথায় আনলি আমাদের পৌলমী?
পল্টন : একেবারে টিপিক্যাল ভিলেজ বস, এই পৌলমী ইলেকট্রিসিটি আছে তো? উ: শুধু ফাঁকা ধূ ধূ ... শুধু সবুজ...
শেখর : এই পাশটায় এই লতানেগুলো কী গাছ বলতো - উঁচু করে বাঁধা? এদিকে আবার নিচে?
পৌলমী : এগুলো চালকুমড়ো আর ওগুলো কুমড়ো।
রায়ান : নাম শুনিসনি, পামকিন রে পামকিন... হোয়াইট গাড্...
রিচিক : এই তোদের এখানে পুকুর আছে? দীঘি?
পৌলমী: হ্যাঁ রে বাবা ইলেকট্রিসিটি জল পাকা রাস্তা সব আছে সব... এই পথেই গ্রাম ঢোকবার মুখেই দেখবি জোড়া দীঘি... শালুক ফুল পদ্ম ফুল।
পল্টন : রাস্তা পাকা তো তুই মাঠ বেয়ে সাইকেল চালিয়ে এলি কেন?
শেখর : শর্টকাট নিশ্চয়ই; এ আবার কোশ্চেন করবার কী আছে?
পৌলমী : শহরের মতো এখানে শর্টকাট ব’লে কিছু নেই শেখর; এখানে এলে আমি ঐ টিলা আর বড় বড় গাছগুলোর পেছনে একটা বড় মাঠের প্রান্তের একটা মন্দিরে রোজ সকাল সাইকেল করে যাই।
রায়ান : তার মানে তুই দূর থেকে আমাদের ট্রেনটা অবজার্ভ করে মাঠের মধ্যে দিয়েই সাঁ করে চলে এলি?
রিচিক : হ্যাঁরে এই গ্রামে মোট কতগুলো পূজো হয়? এনজয় হবে তো?
পৌলমী : দুটো পূজো হয়। একটা যেখান থেকে এলাম ওখানে; একটা বড় মেলাও বসেছে... আর আমাদের বাড়ির পূজো - ব্যাস্!
শেখর : তাহলে তো রিচিক ঠিকই বলেছে - আমাদের শহরের পূজো ছেড়ে এখানে ইনভাইট করে আমাদের ফাঁসালি কেন?
পৌলমী : ফাঁসালাম? কেমন ফ্রেন্ড তোরা? আমি কোনো বছর শহরের পূজো দেখতে পাই? তবু বলবো আমাদের বাড়ির পূজো তোদের শহরের পূজোর দশগুণ ভালো।
রায়ান : ভালো? দশগুণ? কোন অ্যাঙ্গেলে?
পৌলমী : এখানে একটা স্পেশাল বলি হয়। ব্যাপারটা খুব পপুলার- গতবছর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ থেকেও আমাদের মন্দির কভার করেছিল।
রিচিক : দেন্ ইনটারেস্টিং... ব’লি... ঘ্যাচাং...
পৌলমী : এইটিনথ্ সেঞ্চুরী তে ইয়া বড় বড় মোষ বলি হতো... তারপর নাইটিনথ্ এর প্রথম থেকে মোষ বাদ দিয়ে শুরু হল পাঁঠা বলি... এরপর একদিন কূল-পুরোহিত স্বপ্ন পেলেন যে মা প্রাণী হত্যা পছন্দ করছেন না কিন্তু রক্ত তাঁর চাই...
পল্টন : প্রাণী বলি হবে না অথচ রক্ত দিয়ে পূজো?
পৌলমী : হ্যাঁ দেখতে পাবি, ভীষণ সাসস্পিসিয়াস...
রায়ান : আচ্ছা কোনদিন কোনো পূজোয় বাঘ বলি দিত না কেন? শুধু ডোমেস্টিক অ্যানিমেল এর ওপর খবরদারী... ওরা হার্মলেস বলে?
শেখর : ঠিকই ভায়লেন্ট এর সঙ্গে পারবে না তো? ঐ ওরা সব কারা আসছে সামনে?
পৌলমী : ওরা সব আমাদের কর্মচারী... ঐ দ্যাখ আমাদের বাড়ি এসে গেছে।
রিচিক : ঐ পেল্লায় জায়েন্ট থাম ওলা, ওটা বাড়ি?
শেখর : এ তো প্যালেস?
পল্টন : দরজার কাছে বড় বড় দুটো সাজানো হাতি, শুঁড় নাড়ছে? ওরে বাবা জ্যান্ত?
রায়ান : ওই দ্যাখ এনট্রান্সে দশজন ফুল-়ড্রেস্ড গার্ড কাঁধে বন্দুক...
পৌলমী : তোদের জন্য ঐ দোতলায় লম্বা বারান্দা দেওয়া ঘরটা আমি গুছিয়ে রাখিয়েছি - ওখানে গিয়ে তোরা এখন ফ্রেশ হবি, কেমন? আয় আমি নিয়ে যাচ্ছি তোদের।
শেখর : রায়ান দ্যাখ, ঐ যে ডানদিকে চারখানা গাড়ি, সব বিদেশী...!
রিচিক : পৌলমীরা এতো বড়লোক অথচ কোনদিন বুঝতে পর্যন্ত দেয়নি?
পল্টন : এই গাড়িগুলো চলে, না শুধু সাজানো?
পৌলমী : কই রে, আয় ভেতরে আয়, মা বাবা কাকারা তোদের স্বাগত জানাবে বলে অপেক্ষা করছে। ঐ যে ওরাও এসে গেছে আমার গ্রামের সব বন্ধুরা...
শ্যাম : আমি শ্যাম, শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্ত্তী, পৌলমীর বন্ধু।
রি/প : হাই
শে/রা : হ্যালো
মিনি : হাই হ্যালো শহরে বোলো/ভদ্রতা নেই? নাম কি হ’লো!
ও বিন্তি, আমি মিনি... যদিও নামে তোমাদের চিনি।
বিন্তি : হুঁ মনে রেখো এটা কিন্তু গ্রাম, যদিও পরিচয়ে নাম বলাটাই প্রধান তবু আমরা তোমাদের নামগুলো জানি।
পৌলমী : ঘাবড়াসনা আমি তোদের ডেস্ক্রিপশন দিয়ে নামগুলো জানিয়ে রেখেছি - ও- এ হ’ল সন্তু.. ও একটু ভাবুক শুধু মাথায় অঙ্ক ঘোরে... কী সন্তু? কিছু বল?
সন্তু : বন্ধুত্ব হ’ল একটা ধাঁধা- যেমন ট্যান থিটা ইস ইক্যুয়াল টু মানে সমান সমান সিন্ থিটা বাই কস্ থিটা; তেমনি কট্ থিটা সমান সমান কস্ থিটা বাই সিন্ থিটা -সিন্ - কস্ এবং কট্ .... হাহাহাহা...
শ্যাম : বুঝলেনা? লগারিদম্ থেকে দর্শন... চলো আমরা তোমাদের পাশের ঘরেই থাকবো... এসো -
রায়ান : আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, তোরা কেউ বুঝেছিস? ও মাথা চুলকোচ্ছিস যখন বুঝিসনি... ভাই টেল আস ডিটেইলস্...
মিনি : মাথায় গোবর... বুঝলে বন্ধুবর?
‘ট্যান’ হচ্ছে টেনে আনা
‘সিন’ হচ্ছে দেখা
পূজোর কারণ - ‘কস’ বলছে
‘কট’ ধ’রে রাখা...
বিন্তি : হ্যাঁ আমাদের এটাই বন্ধুত্বের সংগা... বুঝলে? চলো পূজো শুরু হয়ে গেল। ... (প্রবল জোরে ঢাক বাজতে লাগল...)
(একসময় ঢাকের শব্দ ক্ষীণ হয়ে বন্ধ হ’লে ঝিঁঝিঁর ডাক শুরু হল মাঝে মধ্যে কুকুরের আর্তনাদ - গভীর রাতের আবহ) (ফিসফিসিয়ে কথা)
মিনি : অ্যায় বিন্তি ঘুমোলি?
শোন একটা কথা বলি
শহরের ওই ছেলেগুলির,
মুখে খুব ইংরাজী বুলি —
বিন্তি : চুপ কর জেগে থাকলে, শুনতে পাবে
ধরা পড়লে প্ল্যান পন্ড হবে...
মিনি : পৌলমী কি থাকবে সাথে?
এই ঘরেতে আজকে রাতে?
বিন্তি : পৌলমী ওর মা-এর কাছে
কাল অষ্টমী পূজো আছে।
মিনি : কাল দুপুরে বলি হবে
একটা কিছু ভোগে যাবে...
বিন্তি : এই যে সিরিঞ্জ ভরছি ওতে
বিঁধলেই ছূঁচ কেল্লা ফতে!
মিনি : কোনটা বলতো? লম্বা মতো?
নাকি মোটা? না না ঐ সুঁটকো টা তো?
বিন্তি : ফিসফিসিয়ে আস্তে বল,
রাতের কথা খুব প্রবল!
মিনি : হ্যাঁ ঐ তো পায়ের আওয়াজ
ঘুমিয়ে আছিস এমনটি সাজ।
বিন্তি : সন্তু ওদের সঙ্গে আছে?
মিনি : নানা ওতো রাতেই ঘরে গেছে!
বিন্তি : আচ্ছা রে... চুপ... শ্যাম কোথায়?
মিনি : শান দিচ্ছে রাম দায় ... (২ বার)
(এমন সময় হুহু করে শেয়াল ডাকে, ঝটপট করে পাখির পাখা... ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে পেঁচা উড়ে যায়...)
(পাশের ঘরে)
রিচিক : এই তোরা ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?
পল্টন : ঘুমোবো কি? এমন জায়ান্ট খাট্... আমারই নিজেরই হ্যান্ড লেগ কিছু খুঁজে পাচ্ছি না...
শেখর : আরে দেয়াল জুড়ে পৌলমীর পূর্বপুরুষের পেল্লায় সব ফোটো যেন কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে।
রায়ান : মাইরী, হাতে আবার তলোয়ার বল্লম- আমরা যেন প্রিজনারস্...
রিচিক : (গলা নামিয়ে) - কিছু শুনতে পেলি পাশের ঘরে কী কথা হচ্ছিল?
শেখর : কাল অষ্টমীপূজো তো তাই... বলি টলি কী সব বলছিল।
পল্টন : জমিদার বাড়ি নরবলিটলি হয় নাতো?
রায়ান : অ্যাঁ, আমাকে কিন্তু এই বাড়ির ঐ কোনায় একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল!
রিচিক : কে? কে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল?
রায়ান : ঐ যে শ্যাম আর সন্তু... একটা আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেয়ার্স, খুব গভীর!
শেখর : বলিস কী?
পল্টন : হ্যাঁ রাজা রাজদের বাড়িতে এরকম গুমঘর থাকে শুনেছি... তারপর?
রায়ান : আমি এই রাজবাড়িটার ভ্যালুয়েশন করছিলাম, ওদের কাছে ডাটা চাইলেম তো... আমাকে বলল থাউজ্যান্ড ক্রোড়...
রিচিক : তাতো হবেই - তার বেশী বই কম নয়। এসব সম্পত্তি ছাড়াও পৌলমীদের বড় দুটো ব্যবসা আছে।
পল্টন : হু, ব্রিক আর অয়ার এর... একচেটিয়া।
রায়ান : আমাকে কি বলল জানিস?
শেখর : কী, কী বলল?
রায়ান : বলল তুমিও বিশাল বড়লোক হতে পারবে, সবটাই তোমার ইচ্ছে। চল এই জায়গাটা ঘুরে আসবে একবার... ব’লে...
শেখর : তুই বললিনা তুই কমার্সের ছেলে তাই খোঁজ নিচ্ছিলি?
পল্টন : আরে দাঁড়া, ইনটারেস্টিং... ইচ্ছে করলেই বড়লোক?
রিচিক : বাকোয়াস... মামারবাড়ি নাকি?
রায়ান : হ্যাঁ পৌলমীর কাকাদের আমি যদি মামা পাতাই?
পল্টন : দূর শুধু আরগুমেন্ট, এত নেগেটিভ ভাবছিস কেন - এই রায়ান আমাকে বল তো, কি করলে বড়োলোক হওয়া যাবে?
রায়ান : আমাকে যক্ষ হতে হবে... অনেক, পাহাড় প্রমাণ ধন রত্ন আমাকে ঘিরে থাকবে... (আবার দূরে কুকুরের কান্না...)
রিচিক : মানে? যক্ষ কি?
শেখর : যক্ষ মানে আমি জানি... বাট ইট্ ইস ইমপসিবল্...
পল্টন : কী রে সেটা - আমি ট্রাই করতে পারি?
শেখর : সেটা বললে রাত্রে ঘুমোতে পারবি না... এখন ঘুমো প্রায় ভোর হ’ল বলে...
রায়ান : হ্যাঁ এবার অবশ্যই ঘুমোনো যাক... গুড্ নাইট এভ্রিবডি।
সকলে : গুডনাইট...
(ঘড়ির কাঁটার আওয়াজ... মিলিয়ে গিয়ে দূরে বাউলের গান... ‘ভোর হইল জগত জাগিল...’ সঙ্গে পাখির কিচিমিচি রব...একটু পরে ঢাকের শব্দ...)
মিনি : ঐ যে শুরু হল বলি
এবার মা দূর্গা রক্তে খেলবেন হোলি... (ঢাকের সঙ্গে শঙ্খ বেজে ওঠে)
শেখর : ওগুলো তো সব পামকিন্, আসবার সময় দেখেছিলাম...হোয়াইট গাড্।
রিচিক : হ্যাঁ বলির ব্যবস্থা তো কিছু দেখছি না?
বিন্তি : এটাই এই পূজোর বিশেষত্ব-ঐ তাকিয়ে দ্যাখো (জোরে ঢাক বাজে)
পল্টন : মাই গড্, এক একটা চালকুমড়োতে কাটার দিয়ে আঘাত করছে আর জায়গাটা রক্তে ভরে যাচ্ছে!
শেখর : তাই তো! অবাক ব্যাপার, তোমাদের এখানকার চালকুমড়ো তরমুজের মতো নাকি?
মিনি : মোটেও তা নয়কো।
ঐ মাচায় উঠে চালকুমড়ো না হয় কেটে দেখো?
রিচিক : এগুলো নিশ্চয়ই তরমুজ...
বিন্তি : এখন তরমুজের সময় নাকি? এবছর ১৮ টা চালকুমড়ো মানত আছে। সবগুলোর ভেতরেই জীব রক্ত... তোমাদের মত বাইরে দিশি ভিতরে বিদেশী।
পল্টন : রক্ত? সত্যি?
রিচিক : এবার কিন্তু আমাদের ইনসাল্ট করছ বিন্তি..., শহর থেকে দেখতে এসেছি বলে? কিন্তু একবার পরখ করে দেখতেই হচ্ছে ব্যাপারটা!
মিনি : কাছে যেওনা কাছে যেওনা..
তবে তোমারই রক্ত চাইবেন মা...
শেখর : আচ্ছা আশেপাশে তো রায়ানকে দেখছি না? মিনি তুমি দেখেছো?
মিনি : তুমি যে তিমিরে, আমিও সেই তিমিরে, বলতো দেখবো কি করে?
রিচিক : সত্যি তো! সন্তু তুমি জানো?
সন্তু : সিঁড়ি ভাঙ্গা অঙ্ক... তিন পূর্ণ বারো... ভগ্নাংশ করো;
মিনি : উত্তর এলে রায়ানকে সুস্থ পেতে পারো।
শেখর : তুমি করো, ডিসগাসটিং...
সন্তু : সোজা খুব... একপূর্ণ একের এক চারবার ধরে নাও, সিঁড়িভাঙ্গা জানো না?
রিচিক : কী মুশকিল... আমরা আমাদের প্রিয় বন্ধুকে খুঁজে পাচ্ছি না বুঝলে?
বিন্তি : দূর অঙ্কটা তাড়াতাড়ি করো না... ঐ যে বলি টলি দিয়ে শ্যাম আসছে ওকে জিজ্ঞাসা করি, শ্যাম রায়ান কোথায় জানিস?
শ্যাম : না, কেন? কী হয়েছে? হারিয়ে গেছে? হাহাহা...
রিচিক : তোমরা জানো, সব জানো - শোনো ইন এনি মিস্আপ্ তোমাদের ছাড়ব না কিন্তু।
পল্টন : আশপাশ দেখ এলাম-নেই; সন্তু মজা না করে বলো রায়ান কোথায়?
মিনি : কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় বন্ধুটি পথ ভুলে
রায়ান গেছে মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে।
সকলে হেসে ওঠে।
সন্তু : উত্তরটা হল - ঊনোসত্তরের একশো এগারো... ভাঙ্গা সিঁড়ি, ভগ্নাংশ।
পল্টন : এরা সর্বদাই কেমন যেন সাসপিসিয়াস। আমার একটুও ভালো লাগছে না। এই পৌলমী, পৌলমী শোন এদিকে?
পৌলমী : কী হল, আসছি; বল কি বলছিস?
রিচিক : এ আমাদের কোথায় নিয়ে এলি বলতো? রায়ানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
শেখর : ্ওদের বলছি তো ওরা মজা করছে...
পৌলমী : কতক্ষণ দেখিসনি ওকে!
শেখর : বেশ কিছুক্ষণ আগে খেয়াল পড়েছে ও নেই - আমি ডেফিনিট এদের মধ্যে কেউ কিছু করেছে ওকে!
পৌলমী : মানে? কী যা তা বকছিস?
শেখর : মানেটা সন্তু শ্যাম মিনি বিন্তিকে জিজ্ঞেস কর।
মিনি : আমরা যদি জানতাম সব ওরে
আগেই ওকে আনতাম ঠিক ধ’রে...
বিন্তি : একটা দামড়া ছেলে কোথায় গেছে আশে পাশে...
রিচিক : জানিস পৌলমী এই এরা রায়ানকে বলেছিল যক্ষ বানাবে।
পৌলমী : যক্ষ মানে?
শেখর : গুপ্তঘরে প্রচুর ধনরত্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ওকে পাহারায় থাকতে বলে সেই ঘর বাইরে থেকে বন্ধ করে দেবে চিরকালের জন্য। তারপর...
রিচিক : হ্যাঁ কী সব বলি টলির কথা বলছিল এই মেয়েদুটো কাল রাতে...
পৌলমী : বলি? রায়ানকে? গুপ্তঘরে যক্ষ? হাহাহাহা... হাসালি। এসব কিছুই এই বাড়িতে নেই, তোরা মিছিমিছি ভয় পেয়েছিস।
পল্টন : তাহলে রায়ান কোথায়? সন্তু কি সব ভাঙ্গা সিঁড়ি না সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক বলছিল...
সন্তু : হ্যাঁ, উত্তরটাও বলে দিয়েছি... এখন সময় মাপছি।
শেখর : সব এই গেঁয়ো বদমাশগুলোর কীর্তি পৌলমী, তুই বিশ্বাস কর ওর একটা কিছু হয়েছে নইলে এতক্ষণ...
পৌলমী : বেশী শহুরে বোলচাল দেখাস না শেখর, সন্তু শ্যাম এই গ্রাম নয় এই বাংলার দুই স্কলার ছেলে - আর মিনি ও বিন্তি দুজনেই জয়েন্ট দিয়ে মেডিকেলে এ বছর চান্স পেয়েছে।
মিনি : গেঁয়ো বলে করলে হেয়ো এই শহুরে বালক
মর্যাদা চাস ফিরে পেতে তো পরীক্ষা তোর হোক্।
বিন্তি : এত বড় অপমান করে তো এ গ্রাম থেকে যাওয়া যাবে না - অতএব সন্তুর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তবেই তোমাদের সকলের মুক্তি। বলো পরীক্ষায় বসবে?
শেখর : হ্যাঁ বসবো, বলো কী পরীক্ষা আছে, কী প্রশ্ন?
রিচিক : দাঁড়া শেখর আগে রায়ানকে ফিরিয়ে দিক ওরা—
পৌলমি : ফিরিয়ে দিক মানে? এই তোরা কি ওকে সত্যিই ধরে রেখেছিস?
সন্তু : দন্ড পলের অঙ্কতে ঘন্টা বাজছে - আসছে সে আসছে। ধ’রে নেই এই নিমেষ শেষ হয়ে পলকে পড়ল - এবার এলো বলে...
পল্টন : আর একটা ফালতু কথা বললে এমন একটা ঝাড়বো না!
মিনি : একদম সাবধান তুলোনা ঘুঁষি
এখুনি প্রমাণ হবে তোমরা ভুষি ভুষি ভুষি...
পল্টন : কী? এত বড় কথা? আমরা ভুষি, তোমরা কী, তোমরা কুমড়ো এক একটা-
রায়ান : এই তোরা কি করছিস এখানে? জানো শ্যাম আজ একাই নেমে গেছি কালকের সেই সুড়ঙ্গে... একশো এগারো সিঁড়ির ভগ্নাংশ এখন উনোসোত্তর টা সিঁড়ি অবশিষ্ট আর তার নিচেই বয়ে চলেছে নদী...
পৌলমী : বোঝা গেল? এবার কী? তোরা আমার শহরের বন্ধু, এরা আমার গ্রামের বন্ধু, আমি চাইনা তোদের কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকুক। নিজেরা মিটমাট করে নে আমি ওদিকের কাজগুলো দেখি...
রিচিক : দাঁড়াও দাঁড়াও! সন্তু, তার মানে যে সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক বললে সেটা কি ঐ আন্ডার গ্রাউন্ড নদীর মুখ... একশো এগারো সিঁড়ি নীচে?
শ্যাম : ঊনোসোত্তর অবশিষ্ট... মিলেছে?
শেখর : আর ঐ দন্ড, পল, নিমেষ... তার মানে এসবেরও মানে আছে?
শ্যাম : আবার বলি, এই জাগতিক সবকিছুতেই অঙ্ক... সন্তু সে সব নিয়েই গবেষণা করে।
মিনি : আমি সেই পুরোনো কথাই তুলি
বেকার কপচাও শুধু ইংরিজি বুলি-
বিন্তি : পলক, মুহূর্ত, নিমেষ, মানে জানো সময় লাগে কতক্ষণ?
শেখোনিতো কিছুই, দেশীয় অঙ্কে দাও নাই একেবারে মন!
শ্যাম : বলো এবার? পারবে? আচ্ছা ক্ষণ শব্দ দিয়েই হোক শুরু। কতো মিনিটে এক ক্ষণ? বলো।
পল্টন : ক্ষণ? অনেক্ষণ, অল্পক্ষণ, বেশিক্ষণ - এর আবার মিনিটের হিসেব হয় নাকি?
সন্তু : অনেক্ষণ, অল্পক্ষণ এসব তো ভাবের কথা - আসলে একক্ষণ হল - চার মিনিট সময়। বলছিলাম না আমি সময় মাপছি?
রায়ান : যা: কলা এর আবার কাউন্টিং আছে? আমি ভেবেছিলাম কতক্ষণ আর লাগবে- যাবো আর একপলক দেখেই চলে আসবো জায়গাটা, কাল থেকে না দেখে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
শ্যাম : এই তো আবার একটা প্রশ্ন, এক পলক, তুমি কতক্ষণ ভেবেছিলে? চোখের পাতা ফেলবে, দেখবে, আর চলে আসবে? তাইতো? কিন্তু পলক কত সময় নেয় জানো?
শেখর : কত? সন্তু বলুক।
সন্তু : এক পলক হল চব্বিশ সেকেন্ড।
রিচিক : নিমেষ আর পলকে নিশ্চয়ই কোনো পার্থক্য নেই?
সন্তু : উহুঁ হলো না বন্ধু... এক নিমেষ অনেক সময় নেয়... ষোলো মিনিট।
পল্টন : আর ঐ দন্ড, মুহূর্ত এগুলো? দন্ড মানে জানতাম শাস্তি, এই তোমরা যা দিচ্ছ... আর মুহূর্তে মুহূর্তে তোমাদের দন্ডর আঘাত সহ্য করছি।
সন্তু : আরে না ভাই না... দন্ড সমান ২৪ মিনিট.. আর মুহূর্ত ঠিক দন্ডের ডবল... ৪৮ মিনিট... আমি রায়ানের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার ঐ হিসেবটাই করছিলাম।
রায়ান : হায় কপাল! ভাগ্যিস আমি অন্তর্ধান হয়েছিলাম তাই কতকিছু শিখলাম।
রিচিক : সত্যি, এসব জানতামই না, শুনিওনি কখনো!
পল্টন : আমাকে মাপ করে দিও সন্তু, খুব খারাপ ব্যবহার করেছি আমি...
সন্তু : একটা শর্তে মাপ হবে - যদি আজ সারারাত তোমরা তোমাদের গলায় গান কবিতা এসব শোনাবে বলো, আমরাও বলবো নিশ্চয়ই...
শেখর : সে না হয় হবে - এখন বলো তো রায়ানকে কেন বলেছিলে যক্ষ হতে?
শ্যাম : ওটা তো মজা। সবসময় টাকার হিসেব করলে বুড়ো বয়সে যক্ষি হতে হয়। ভোগ আর হয়ে ওঠেনা... জীবন থাকবে না টাকা রয়ে যাবে।
রায়ান : গতকাল রাতে কিন্তু মিনি আর বিন্তি আমায় টার্গেট করেছিলে বলো? সত্যি বলো?
রিচিক : হ্যাঁ মারবে বলে কী একটা ইনজেকশন্ রেডি করছিলে না?
মিনি : একীরে এরাই তো চালকুমড়ো
ধর প্যাঁকাটি গোবদা মুড়ো...
বিন্তি : হাহাহাহা - আমরা চালকুমড়ো বলির জন্য বাছাবাছি করে পরিস্কার করে রাখছিলাম - আর ছড়ায় কথা বলছিলাম...
মিনি : তুমি সত্যিই এক চালকুমড়োই বটে-
পালিয়ে ছিলে পূজোর কালে জীবন সংকটে?
পল্টন : ইন্জেকশন এর কথা আমিও শুনেছিলাম...এখন পাশ কাটাচ্ছো কেন?
রায়ান : তবে শুনবে? তোমাদের কীর্তি আমি কাল রাতেই লুকিয়ে দেখে এসেছিলাম। তাই সকালে বলির ওপর আর কোনো ইনটারেস্ট ছিল না - বরং সিঁড়িটা টেনেছিল খুব বেশি... নীচে একটা গুম গুম আওয়াজ পাচ্ছিলাম - আজ দেখে এসে স্বস্তি।
শেখর : ইনজেকশন মানে ঐ ব্যাপার নাকি? একটা মিথকে বাঁচিয়ে রাখতে এত বড় জালিয়াতি?
সন্তু : অতো সোজা নয় সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, এও পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া এক জটিল নলের অঙ্ক...
শ্যাম : এবং ভীষণ গোপন যার সঙ্গে রাজবাড়ির ঐতিহ্য জড়িত। যদি সবটা জানতে হয় তো পৌলমীর কাছে জেনে নিও। বুঝলে? আর ঐ নিয়ে বেশি মাথা ঘামিওনা।
মিলি : চলো - ঐ হচ্ছে এখন প্রসাদ বিতরণ
আর ঢাক কী বলছে? অষ্টমী শেষ তাই।
সকলে : ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ
ঠাকুর যাবে বিসর্জন...
ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ
ঠাকুর যাবে বিসর্জন...
(জোরে ঢাকের আওয়াজ সঙ্গে কাঁসি)
॥ সমাপ্ত ॥