অনেকদিন আগের কথা, তখন আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য আদা জল খেয়ে লেগে প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভোর থেকে রাত সারা দিন শুধু পড়া আর পড়া। পড়তে পড়তে একঘেঁয়েমি লাগছে। টেষ্ট পরীক্ষাও ভালো হল। আমিই প্রথম হতাম বরাবর। এবারেও ফার্স্ট হলাম। বাবা মা তো ভীষণ খুশি। বাবা বললেন চল তোকে আমার মামার বাড়ী নিয়ে যাবো। অনেকদিন বলেন, যেতে পাই না। বাবার মামার বাড়ী লক্ষীকান্তপুর নামে একটা গ্রামে। বর্ষাকাল, পথ ঘাটে জল থাকবে কাদা থাকবে, তবু চল তো, বর্ষাকালে গ্রাম কেমন হয় দেখবি। পুকুর গুলো জলে টইটম্বুর, নদীটাও দুকুল ছাপিয়ে বইছে। ভালো লাগবে। আমি তো এক পায়ে খাড়া। যেতে রাজী হয়ে গেলাম। মা বললেন দেখো ওকে সামলে রেখো। বেশী দূরে যেতে দিও না। বেশ দু একদিন পরেই আমরা রওনা দিলাম। বাসের পর খানিকটা পথ রিক্সা করে যেতে হয়। বর্ষার দিন,রিক্সা পেলাম না। বাবা আর আমি হাঁটছি বৃষ্টিতে পথ ঘাট পিছল। যেতে যেতে হঠাৎ পা পিছলে ধপাস। অভ্যেস নেই শহরে থাকি। বাবা ধরে তুললেন, তেমন লাগে নি। হঠাৎ শুনতে পেলাম একটা ছেলে যেন খিল খিল করে হাসছে। আর বলছে, এ রাম দিদিটা পড়ে গেল, পড়ে গেল। একে তো পড়ে গেছি তার লজ্জা, সেই সঙ্গে হাসলে কিরকম রাগ ধরে! খুব রেগে আছি, তবুও অবশেষে বাড়ী পৌঁছে গেলাম। বাবার মামার বাড়ীর সকলে আদর আপ্যায়ণ করতে লাগলো। খুশি হলাম আনন্দ হচ্ছে। এমন সময় বাবার ছোট মামীমা মানে আমার দিদা বলছেন,এ মা তুই পড়ে গেলি!! তাই ভাবছি। জামায় কাদা কেন লেগে! লজ্জা পেলাম খুব। পাড়াগাঁয়ে তাড়াতাড়ি রাত গভীর হয়। নটা বাজতেই একটা জোর কলরব। কারা যেন এ কসাথে অনেক কথা বলছে। দিদা বললো যাবি নাকি মুনিয়া বাইরে কি হল দেখতে। কিসের এত চিৎকার!! এক হাতে হ্যারিকেন অন্য হাতে ছোট দিদার হাত ধরে বেরিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম অনেক ছেলে বুড়ো মহিলা মিলে সাপ সাপ বলে চেঁচাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম সেই ছেলেটা যে আমায় রাস্তায় পড়ে যেতে দেখে হেসেছিল, লাঠির মধ্যে একটা বিষধর সাপ জড়িয়ে এগিয়ে আসছে। সবাই বলে উঠলো, এতো খরিস! তোর কি একটুও ভয় নেই সন্তু? যদি তোকে কামড়ে দেয় কি হবে? ও কি যে বল! এ সাপ আমায় কামড়াতে পারবে না। বারো কি তেরো হবে একটুও বুকে ভয় ডর নেই। এই ছেলে সম্পর্কে নানা জনে নানা কথা বলছে। সাবাস সন্তু সাবাস। দিদা বললেন জানিস মুনিয়া গতবছর একটা ছেলে ছিপে মাছ ধরতে গেছিল। জলে পড়ে ডুবে যায়। ঐ সন্তুই সাঁতরে পাড়ে নিয়ে আসে। সবাই ভেবেছিল ছেলেটাকে বাঁচানো যাবে না। ও মা পেট চিপে চিপে জল বের করে ঠিক বাঁচিয়ে দিল। সন্তু এমনই। পরোপকারে ওর জুড়ি নেই একটা। গল্পে শোনা যায় বাস্তবে এমন ছেলে দেখতে পাবো ভাবি নি। যাই হোক সন্তুর কথা ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
কেবলই এই ছেলেটির কথা। ভুলতে পারছি না। মনে মনে প্রার্থনা করছি বেঁচে থাক ভাই আমার। তুই অনেক বড় হবি। এমন মানুষ আমাদের সমাজে খুব দরকার। সবাই তো পড়াশুনা করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। তুই নেতাজীর মতো দেশ প্রেমিক হবি ভাই। এই ঘটনার পরের দিন ছেলেটা দাদুর বাড়ীতে এল। বলছে ও কাকীমা, ও জেঠিমা তোমরা আর তোমাদের বাড়ী যারা এসেছে সবাই নদীর পাড়ে আসবে বিকেল পাঁচটায়। সাঁতার প্রতিযোগিতা হবে। দামোদর নদে যেন প্লাবন। পাড় ভাঙা নদী। ওমা যেই না আমরা নদীর ধারে এসেছি, ছেলেটি ছুট্টে আমার কাছে এসে বললো। জানো দিদি, তুমি আসাতে আমি খুব খুশি। তুমি শহরে থাকো, এমন খেলা দেখনি। আমাকে বলছে তোমায় একটা প্রণাম করবো? আমি কোনদিন স্কুলের পরীক্ষায় ফাস্ট হই নি। এবার কিন্তু হবই।আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। নির্দিষ্ট সময়ে বাঁশী বাজতেই সবাই লাফিয়ে পড়ল দূরন্ত নদীতে। প্রতিযোগী জনা পনেরো। নিজের মনেই প্রার্থনা করছি সন্তু যেন জিতে যায়। সবাই প্রাণপণে সাঁতার কাটছে সবাই আপন আপন ছেলেদের উৎসাহ দিচ্ছে। আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম আরও জোরে সন্তু ভাই, আরও তাড়াতাড়ি। এত বড় জলস্রোতে কাউকে আর দেখতেই পাচ্ছি না। সন্তু আমার চিৎকার শুনতে পেয়েছিল কি না জানি না। যখন রেজাল্ট ঘোষনা করলো শুনলাম সন্তুই ফার্স্ট। আমার আনন্দ আর ধরে না। মনে মনে এই সাহসী ছেলেটাকে আমার ভাই এর আসনে বসালাম। আসলে আমার নিজের ভাই নেই তো!!
পরের দিন সকালেই আমাদের ফেরা। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি, আমি আর বাবা। বাস তখনো দূরে। সেই সন্তু হাঁপাতে হাঁপাতে কোঁচড়ে চারটে ডাঁসা পেয়ারা আমার হাতে দিয়ে চলে গেল। দৌড়াতে দৌড়াতে বলছে পেয়ারাগুলো খাবে, আবার আসবে দিদি!!!