“শুনছ - ও - ও - - -”
বার দুয়েক ডাকটা শুনেই মাথা খারাপ বিল্টুর ঠাকুমার, “বাপরে- এ - এ, বুড়োর গলা শুনেছ বউমা! কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল যেন!”
পাশেই রান্নাঘরে ব্যস্ত বিল্টুর মা হেসে উঠল। আবার ডাকা শোনা গেল “ বউমা - আ - আ - ।”
চেঁচিয়ে উঠল বিল্টুর ঠাকুমা, “তোমাকে হাত জোড় করছি বউমা দয়া করে শুনে এসো তোমার শ্বশুরমশায় কী বলছেন। নইলে এরপর পাড়ার লোক এসে কথা শুনিয়ে যাবে; তখন ভালো লাগবে তো ?”
হেসে উঠে বিল্টুর মা জবাব দিল, “চা হয়ে গেছে মা; চা নিয়েই একেবারে যাচ্ছি।”
বিরক্ত হল ঠাকুমা, “উফ, আর পারি না বাবা এই মানুষটাকে নিয়ে। গিয়ে জিজ্ঞাসা করবে তো তোমার শ্বশুরকে - বাড়ির পাশে কী গম ভাঙা মেশিন চলছে না খড় কাটা মেশিন চলছে যে অমন করে চেঁচিয়ে কথা বলছে। নাকি বাড়ির সবাই কালা?”
পাশে দাঁড়ানো বিল্টু হেসে উঠল, “দাদুভাইয়ের গলাতে সাইলেন্সার লাগাতে হবে ঠাম্মা।”
ওর মা ইশারাতে বিল্টুকে থামিয়ে দিল,“তুই এখনও অনেক ছোটো; অমন কথা বলবি না। দাদুভাই আমার থেকেও কত্ত বড় জানিস ?”
চায়ের কাপ হাতে মা দাদুভাইয়ের ঘরের দিকে রওনা হতেই বিল্টু ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরল দু হাতে, “দাদুভাইকে অমন কথা বলে ফেললাম বলে তুমি রাগ করলে ঠাম্মা?”
বিল্টুর চুলে বিলি কেটে দিল ঠাম্মা, “না রে দাদুভাই তোর ওপর কী রাগ করতে পারি! তুই তো ঠিকই বলেছিলি। আর আমি জানি - দাদুভাইকে তুই কত ভালবাসিস।”
একটু পরেই বিল্টুর মা চা দিয়ে ফিরে এলো, “বাবা চটি খুঁজে পাচ্ছেন না মা।”
অবাক হলো ঠাকুমা, “ভোরবেলা থেকে চটি পায়ে কোথায় যাবে যে চটির খোঁঁজ করছে!”
বিল্টুর মা হাসল, “ঘরে পরার চটিই হবে হয়ত জানি না ঠিক।”
ছ্যা ছ্যা করে উঠল ঠাকুমা , “সেই রঙচটা কুচ্ছিত চটিগুলো? ভালো হয়েছে হারিয়েছে। আপদ বিদায় হয়েছে ঘর থেকে। বলেবলে তো ছাড়াতে পারছিলাম না। খোকার আনা নতুন চটি, ছাতা সব পড়েই আছে ! আসলে তো কিপটে; নতুন জিনিস পরতে মায়া লাগছে, বুঝলে।”
বিল্টুর মা হেসে ফেলল কথাগুলো শুনে, “সে আপনি যা- ই বলুন মা, বাবা কিন্তু অস্থির হয়ে পড়েছে। আপনাকেই ডাকছেন - - -। একবার যান আপনি। আমাকে তো চায়ের জন্য ডেকেছিলেন। বললেন আপনাকে একবার পাঠিয়ে দিতে।”
ঠাকুমা যেন শুনতেই পেল না। আবার দাদুর ডাক শোনা গেল, “শুনছ - ও - ও - ও - -” সবজি কাটতে ব্যস্ত ঠাকুমা রাগ করে বঁটিটা সজোরে উল্টে রেখে হাঁটা দিল দাদুর ঘরের দিকে, “ আজ বিল্টুর দাদুরই একদিন কী আমারই একদিন।”
ঠাকুমার পেছনে বিল্টুকে যেতে দেখে দিদি জানলা দিয়ে গলা বাড়ালো, “এই তুই কোথায় চললি রে? এখনই অঙ্ক-স্যার আসবেন ।”
ঘুরে গিয়ে বিল্টু সোজা পড়ার টেবিলে চেয়ার টেনে বসে পড়ে স্বগতোক্তি করল, “রোজরোজ অঙ্ক ভাল্লাগে না, ধ্যু - র ।”
অঙ্ক স্যার খুব গম্ভীর। আর অঙ্ক ভুল হলে যা ব্যবহার করেন - - -। উরেব্বাস, সেটা আর ভাবতে পারে না বিল্টু। মনে হয় খাঁচা ছাড়া বাঘ যেন - - -। অঙ্ক স্যারের ভয়েই ও ছোটো ক’রে চুল কাটে। এ সব কথা কারও কাছে ফাঁস করে না ও। করলে সম্মান থাকবে না ।
আজ যে অঙ্ক স্যার সকালের বদলে বিকেলে আসবেন বলেছিলেন সেটা ভুলে গেছে ও। দিদি মুখ টিপে হাসছে দেখে বিল্টু রহস্যের গন্ধ পেয়েছিল, “কী রে দিদি, তুই আজ খেপির মত হাসছিস যে বিনা কারণে !”
দিদি মজা করেছিল, “পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই।” একটু থেমে দম নিয়ে দিদি রহস্য করল, “খেপি যখন নই তখন হাসার নিশ্চয় কারণ আছে।”
দিদি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে - লক্ষ্য করল ও। কানে এলো মায়ের চটির আওয়াজ। দাদুর ঘরের দিকে গেল মা ।
ঠাকুমা গিয়েই গলা চড়িয়েছে, “কী সোনা - রুপো চুরি গেছে তোমার যে ভোরবেলাতেই চেঁচিয়ে পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙিয়ে দিলে? কী বলবে পাড়ার লোকে? এমনিতেই তো উকিলদেরকে কেউ পছন্দ করে না - সেটা জানো নিশ্চয়।”
দাদুরও রাগ কম নয়, “বলবে আবার কী! আমার জিনিস হারালে আমি চেঁচাব না তো কি অন্য লোক চেঁচাবে?”
ঠাকুমাও কম যায় না, “বলবে বুড়োটা পাড়ার লোককে ঘুমোতেও দেয় না। ভোর থেকে ঘরে চেঁচামেচি করে। নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছে। মা গো, কী গলা , ঘরে যেন ডাকাত
পড়েছে!”
দাদুও কম যাবে না, “থাক তাহলে, বলব না। কেন আবার পাড়ার লোকের ঘুমের ব্যাঘাত হয়।”
দাদুকে হঠাৎ চুপ করে যেতে দেখে নরম হ’ল ঠাকুমা, “যা বলবার তাড়াতাড়ি বলো বাপু, না হলে চললাম। খোকা কাজে যাবে এখনও রান্না চড়ানোই হয়নি।”
দাদু ব্যস্ত হয়ে পড়ল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি বরং যাও; গিয়ে বউমাকে পাঠিয়ে দাও।”
ঠাকুমার ফিরতে দেরি দেখে বিল্টুর মা উপস্থিত হ’ল দাদুর ঘরে। বিল্টুর মাকে দেখে দাদু যেন ভরসা পেল, “চটি জোড়া খুঁজে পাচ্ছি না বউমা। তুমিই একবার দেখো, যদি খুঁজে পাওয়া যায়।”
রাগ হয়ে গেল ঠাকুমার, “নতুন চটি জোড়া নয় তো? খোকা যেগুলো কয়েক দিন আগেই কিনে আনল সেইগুলো কি? বাটার সেই চটিগুলো ভারী সুন্দর দেখতে ছিল, সেইগুলো হারিয়ে ফেলনি তো গো?”
ব্যস্ত হয়ে পড়ল দাদু, “আরে না না, হারাবে কেন! ঘরেই কোথাও আছে, এ দিক ও দিক।”
রাগে যেন খেপে গেল ঠাকুমা, “সব্বনাস, সেগুলোর যে অনেক দাম ছিল গো ! নশ নিরানব্বই টাকা না কত যেন বলেছিল খোকা।”
দাদু চেঁচিয়ে উঠল, “তুমি থামবে দয়া করে।” ঠাকুমাও কম যায় না, “কেন থামব? থামবটা কেন - ও- ও ? খোকার পয়সাগুলো বুঝি খোলামকুচি ?”
ঠাকুমাকে থামাতে না পেরে দাদু বিল্টুর মাকেই সাক্ষী মানল, “এ তো মহা জ্বালা হল বউমা! কোনো কথা ভালো করে শোনেও না, বোঝেও না। আর সব বিষয়ে মাথা গলাবে !”
ঠাকুমা সোজা বলে দিল, “কাল তুমি ব্যাংকে গিয়েছিলে; নিশ্চয় সেখানেই ফেলে এসেছ, নিশ্চয়-ই-ই।”
চিৎকার করে উঠল দাদু, “ব্যাংকে চটি খুলে কেন ঢুকতে যাব - ও - ও ? মাথাটা কি গেছে তোমার !” মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে বুঝতে পেরে ঠাকুমা চুপ করে গেছে। দাদু সেই ফাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করল বিল্টুর মাকে, “নতুন চটিগুলো নয় গো বউমা; ঘরে পরার নীল হাওয়াই চটিগুলো পাচ্ছি না, বুঝলে।”
ঠাকুমা শুনেই আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল, “মা গো, সেই খসটে মেরে যাওয়া, সেফটিপিন আটকানো হতকুচ্ছিত হাওয়াই চটিগুলো? ছ্যা: ছ্যা: ছ্যা:, ওগুলো আবার ভদ্দরলোকে পরে! অবশ্য উকিলরা কি ভদ্দর লোকের মধ্যে - - -।”
দাদুর কানে ঠিক মত যায়নি কথাটা, “তুমি আবার সেফটিপিন কোথায় পেলে! হ্যাঁ তবে বলতে পার রঙটা একটু - - -।”
ঠাকুমা কথাগুলোতে পাত্তাই দিল না, “ওই একই কথা হল আর কী। এবার সেফটিপিন লাগাতেই হ’ত তাই বললাম। তবে একটা কথা বলতেই হচ্ছে - উকিলদের পছন্দ কখনও ভালো হয় না। সারাজীবন কালো কোট পরেপরে কালো রঙ ছাড়া অন্য কোনো রঙ চোখেই ধরে না উকিলদের।”
দাদুর মুখে হাসি, “কালো বাজারিদের ধরি আমরা, তা - ই কালো রঙ পছন্দ করি। কিন্তু তুমি এত জানলে কোত্থেকে! তোমাদের সাত কুলে কেউ ওকালতি করেছে বলে তো শুনিনি বাপু !”
ঠাকুমার মুখে তৃপ্তির মিটিমিটি হাসি, “আমাদের গুষ্টিতে বেশির ভাগই ডাক্তার। ওকালতি করতে যাবে কোন দুঃখে! যত্ত চোর ডাকাতদের সংগে মেলামেশা, ছিঃ।”
দাদুর কন্ঠে ব্যঙ্গ, “তা অবশ্য ঠিক; সবাই ডাক্তার তবে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। একটাও এলোপ্যাথি নে - এ - ই।”
দাদু বুড়ো আঙুল নেড়ে কথাগুলো বলাতে ঠাকুমা রেগে আগুন, “সে তো বলবেই এখন! যখন বাতের ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়ে কোর্ট যাওয়া বন্ধ হওয়ার যোগাড় হয়েছিল তখন এই হোমিওপ্যাথি ডাক্তাররাই রক্ষা করেছিল।”
দাদু যেন মজা পেয়ে গেল, “তোমার বাবা একরকম জোর করেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেছিল। আমি নিজে যায়নি সেধে। আসলে শ্বশুরমশায় বলে কথা ; সম্মান রাখতে
‘না’ কথাটা বলতে পারিনি।”
উত্তেজিত হয়ে ঠাকুমা কোমরে আঁচল জড়াতে শুরু করেছে তখনই দাদু বলে বসল, “কোনোদিন উকিল রোগী পাননি তাই ধন্য হয়ে আমাকে - - - ।”
ঠাকুমা দাদুকে কথা না এগোতে দিয়ে বলল, “আমার বাবা বলত, - উকিলরা নাকি কোনোদিন কোট কাচতে দেয় না। ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই হয়ে গেলে একেবারে ফেলে দেয় ।”
ঠাকুমার কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে বিল্টুর মা। দাদু হো হো করে হেসে উঠল, তা যা বলেছ।”
এদিকে অঙ্ক স্যার আসছে না দেখে বিল্টুর খেয়াল পড়েছে - উনি তো আজ বিকেলে আসবেন বলেছিলেন। অপেক্ষা না করে দিদির হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে দাদুর ঘরে হাজির।
সবাই হাসছে দেখে বিল্টু ঠাম্মার হাত ধরল, “কী হয়েছে, সবাই হাসছে কেন ঠাম্মা ?”
বিল্টুকে দেখে দাদু যেন ভরসা পেল, “ঘরে পরার চটিগুলো পাচ্ছি না রে দাদুভাই। সেই কথাটা বলতেই তোর ঠাম্মা সাতশ কথা শুনিয়ে দিল সকাল বেলা।”
একটু থেমে দম নিয়ে দাদু আবার শুরু করল, “অবশ্য আমি তাতে কিছু মনে করি না।
কারণ মেয়েরা কথা বেশি বলে - এতো সবাই জানে; কাজের বেলা - - -।”
ঠাকুমা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, “অ- - -অ, সারাদিনে চার বার চা, দু বার জলখাবার, দুবার খাবার মুখের সামনে বুঝি ভূতে দিয়ে যায় ?”
দাদু জোরে হেসে উঠল , তোমার হাতের চা দেখলে লজ্জা লাগে খেতে। ভাগ্যিস আজকাল চা’টা বউমা করে তাই মুখে দিতে পারি নইলে - - - । আর রান্নার কথা আর বোলো না। বাজার থেকে কুমড়ো, পটোল, ঝিঙে, লাউ যা - ই আনি না কেন রান্নার পর খেতে সব একই রকম লাগে। আমি বলেই খাই, অন্য কেউ হলে - - - । তবে ওসব কথা থাক। বিল্টু দাদুভাই তুই আমার চটিগুলো দেখ তো খুঁজে পাস কিনা। নাকি তোর ঠাকুমা ফেলেই দিয়েছে।”
বিল্টু হেসে উঠল, “তুমি যে সেদিন বললে - চটি জোড়ার রঙ উঠে বড় বিচ্ছিরি দেখাচ্ছেরে; খালি পায়ে কোনো ভিখারি এলে দিয়ে দিস। গরমকালে গরম পিচ রাস্তা থেকে অন্তত পাগুলো তো বাঁচবে।” পাশে দাঁড়ানো দিদি বিল্টুকেই সমর্থন করল, “হ্যাঁ গো দাদুভাই, আমার সামনেই তুমি ভাইকে কথাগুলো বলেছিলে। আর বলেছিলে -বুড়ো মানুষ হলে পুরোনো ছাতাটাও দিয়ে দিস। বয়স হয়ে গেলে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করা বড় কঠিন রে। ছাতাটা লাঠির কাজও করবে আর রোদ-জলটাও আটকাবে।”
বিল্টু সরে গিয়ে একেবারে দাদুর গা ঘেঁসে দাঁড়ালো, “সেই জন্যেই তো কাল একজন বুড়ো ভিখারিকে দেখে ছাতা, চটি সব দিয়ে দিয়েছি।”
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল দাদুর মুখ, “খুব ভালো করেছিস দাদুভাই; কিন্তু আমাকে অন্তত একবার বলবি তো। আমি ভাবলাম বুঝি - - -”
হেসে উঠল ঠাকুমা, “চোরে নিয়ে গেছে, তাই তো? এতদিন ওকালতি করে এই বুদ্ধিটা হলো না যে অমন ভেঁকের চটি কখনও চোরে নেয়। ধন্য বুদ্ধি বটে তোমার, ছিঃ !”
ঠাকুমার কথার জবাব না দিয়ে দাদু বলল, “সংসারের চাপে সব ভুলে যাইরে দাদুভাই। কাকে যে কী বলেছি মনেই থাকে না রে।”
ঠাকুমা মুখ বেঁকিয়ে বলে গেল, “কাজের মধ্যে দুই - খাই আর শুই।”
বিল্টুর মা দিদিকে বলে গেল, “তোর বাবার আনা নতুন ছাতা, চটি জোড়া এনে দাদুভাইকে দিয়ে যা এখনই।”
হঠাৎ দাদুর খেয়াল পড়ল, “তোর ঠাম্মা কী যেন বলে গেল রে দিদিভাই? ভালো কথা তো নিশ্চয় নয়।”
দিদি বলল, “বলে গেল আজ থেকেই নতুন ছাতা আর চটিগুলো ব্যবহার করবে, বুঝলে?”
বিল্টুকে ধমক দিল, “ আর তুই দাদুভাইকে বলতে ভুলে গেলি কী করে যে চটি আর ছাতা ভিখারিকে দিয়ে দিয়েছিস! সকাল থেকে মাথা খারাপ করছে দাদুভাই।”
দাদুভাইয়ের হাতটা ধরে বুক ফুলিয়ে বিল্টু বলল, “মনে রাখিস - আমার দাদুর নাম ভোলানাথ চ্যাটার্জি; সুতরাং আমিও মাঝেমাঝে ভুলে যেতেই পারি।”