বাপরে কি ডানপিটে ছেলে? কোন দিন ফাঁসি যাবে, নয় যাবে জেলে।
সুকুমার রায় তার আবোল তাবোল- এ এই কবিতাটি কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন বলা কঠিন। কারণ সুকুমার রায় যে সময় জীবিত ছিলেন সেই উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলনে ফাসি যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল বাংলার ঘরে ঘরে অসংখ্য ডানপিঠে দামাল ছেলে। তাদেরই একজন ছিলেন কানাই লাল দত্ত। ৩০ আগস্ট ১৮৮৮ সালে তার জন্ম হয়েছিল চন্দননগরে।
বালক বয়েসে তাকে চন্দননগরের ডুপ্লে বিদ্যামন্দিরে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই কানাইলাল দত্তের জীবনে পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি ভারতের ইতিহাস সমন্ধে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ও বিভিন্ন লেখকের রচনা পাঠ করেন। অচিরেই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ন কানাই বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে যান। প্রথমে তাকেই নির্বাচন করা হয়েছিল কিংস ফোর্ট কে হত্যা করার জন্য। পরবর্তীকালে যার দায়িত্ব বর্তায় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর উপর। এরপর কানাইলাল বারীন ঘোষের দলের সঙ্গে কলকাতায় বোমা তৈরির কাজে যোগ দেন। ১৯০৮ সালের ২ মে তিনি উত্তর কলকাতার ১৫ নম্বর গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে মানিকতলা বোমা মামলায় অস্ত্র আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। এদের সঙ্গেই অরবিন্দ ঘোষ বারীন ঘোষ সহ, নরেন গোসাই গ্রেপ্তার হন। নরেন গোসাইয় বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজ সাক্ষী হতে রাজি হয়ে যান। এই বিশ্বাসঘাতক নয়ন গোসাইকে শাস্তি দেয়ার জন্যই তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন কানাইলাল দত্ত ও তার বন্ধু সত্যেন্দ্র।
সেই দিনটি ১৯০৮ সালের ৩১ শে আগস্ট। ঘড়ির কাঁটায় সকাল পৌনে সাতটা। কোমরে গোঁজা রিভলভার থেকে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় রাজসাক্ষী হতে চাওয়া বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে লক্ষ্য করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন সত্যেন-কানাই।
নরেন গোঁসাইকে খুন করেও নিরুত্তাপ ছিলেন কানাই। কারারক্ষীদের সামনে পেয়ে বলেন ‘অ্যারেস্ট মি’।
প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রফুল্ল চাকির মত তিনি আত্মহত্যা করলেন না কেন? জবাবে কানাই বলেছিল, আমি পলিটিক্যাল মার্ডার সফল করতে চেয়েছিলাম। আমি জানি আমার ফাঁসি হবে। আমি সেটাই চাই।
বিচারে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল কানাইয়ের। মৃত্যুদন্ড রদের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করবেন কিনা জানতে চাওয়া হলে কানাই বলেছিলেন, “দেয়ার শ্যাল বি নো আপিল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এই কথা শুনে বলেছিলেন - কানাই শিখিয়ে গেল যে শ্যাল আর উইল ব্যবহারের পার্থক্য কিভাবে কোথায় করতে হয়। কানাই বাঙালি জাতিকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে গেল।
ফাঁসির আদেশ পাওয়ার পরে আলিপুর জেলে পাশাপাশি সেলে ফাঁসির প্রতীক্ষায় দিন গুনছে কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সত্যেন ব্রাহ্ম। সত্যেনের ইচ্ছে মৃত্যুর আগে একবার সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের কর্ণধার পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে তাঁর কাছ থেকে আশীর্বাদ চাইবেন। জেল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিল। পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী জেলে ঢুকে সত্যেনকে আশীর্বাদ করে গেলেন। কানাইয়ের এক পরিচিত শিবনাথ শাস্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কানাইকে দেখেছেন কিনা। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন - “কানাইকে দেখলাম, সে পায়চারি করছে - যেন পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহ ! বহু যুগ তপস্যা করলে তবে যদি কেউ তাকে আশীর্বাদ করার যোগ্যতা লাভ করতে পারে।”
জেলখানায় মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কানাই তার মাকে বলল, এতদিন তুমি শুধু আমার মা ছিলে। আজ তুমি সারা দেশবাসীর মা হয়ে গেলে। একি কম ভাগ্যের কথা।
মৃত্যুর আগের দিন দাদা আশুতোষ বলেছিলেন, তোর চশমাটা দে একটা কিছু তো আমার কাছে থাক। কানাই বলে, দাদা চশমাটা আমি এখন দিতে পারব না। চোখে হাই পাওয়ার। কাল যদি চশমা ছাড়া হোচট খাই এরা ভাববে বাঙালির ছেলে মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে। চশমা তুমি মৃত্যুর পরেই নিও। মৃত্যুদন্ডের আদেশ পাওয়ার পর ওর ওজন অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
মুখে সর্বদা হাসি লেগেই থাকত। ফাঁসির আগেরদিন ওয়ার্ডার তাঁকে বিদ্রুপের সুরে একবার বলেছিলেন, আজ তুমি হাসছো কিন্তু কালকে ফাঁসির আগে তোমার মুখ থেকে হাসি হারিয়ে যাবে। সেদিন কানাই শুধুই হেসেছিলেন।
১৯০৮ সালের ১০ই নভেম্বর। ভোর পাঁচটা। আলিপুর জেলে সেদিন উপস্থিত পুলিশ কমিশনার মিস্টার হ্যালিডে, ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার বোমপাস। সহ ৩০০ সশস্ত্র উর্দিধারী। জেলের ঘড়িতে তখন সকাল ছয়টা। কিছু কারারক্ষী কানাইয়ের জেলের দরজা খুলে তাঁকে নিয়ে আসলেন। মুখে সেদিনও হাসি লেগেই আছে। চোখে উজ্জ্বল দ্যুতি। হাত পিছনে বাঁধা। কানাইকে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগোলেন তারা।
ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগোতেই কানাইয়ের চোখে পড়ল সেই ওয়ার্ডার। কানাই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ওয়ার্ডারকে লক্ষ্য করে - “ আজকে আমাকে কেমন দেখছো? সেদিন আর ওয়ার্ডার কোন জবাব দিতে পারেননি।
বীরদর্পে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন কানাই। গলায় পড়ান হল ফাঁসির রজ্জু। জল্লাদকে লক্ষ্য করে কানাই বললেন -
“দড়ি বড় কড়া হয়েছে। গলায় লাগছে।”
দড়ি খুলে আবার গলায় লাগানো হল। মুখ ঢেকে দেওয়া হল কালো কাপড়ে।
ফাঁসির পাটাতন সরে গেল। নীচে নেমে গেল কানাইয়ের দেহ। ফাঁসির রজ্জু কিছুক্ষন কাঁপল। তারপর স্থির হয়ে গেল। অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন কানাই।
কানাইয়ের দেহ সেদিন জেল থেকে আনতে গিয়েছিলেন দাদা আশুতোষ দত্ত এবং সতীর্থ মতিলাল রায়। কানাই বলে গিয়েছিলেন আমার মৃত্যুর পর দেহ নিয়ে শোক নয়, শোভাযাত্রা বার কর।
সে দিন তাঁর শবদেহ নিয়ে কলকাতা শহরের বুকে এক জনপ্লাবনের সাক্ষী থেকেছে পুলিশ। লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে এক বারের জন্য হলেও শববাহী খাটটি ছুঁতে চায়। সর্বত্র ‘জয় কানাই’ ধ্বনিতে আন্দোলিত। কেওড়াতলা শ্মশানে দাহকার্যের পর কানাইলালের ‘চিতাভস্ম’ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়। আধ ছটাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। পুলিশের পদস্থ কর্মচারী এফ সি ড্যালির বক্তব্য: “কানাইলাল দত্তের চিতাভস্ম বলে কলকাতায় যা বিক্রি হয়েছিল, অনুমান করা হচ্ছে তা চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ গুণ বেশি!”
এই বিপুল জনসমুদ্র ব্রিটিশ শাসনকে সাংঘাতিকভাবে নাড়িয়ে দেয় যে তারা সিদ্ধান্ত নেয় ফাসীর আসামীর দেহ আর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে না॥