পণ্ডিত প্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের কাছে উভয়েই প্রাতঃস্মরণীয় মহৎ মানুষ। এঁদের দুজনকে একত্রে স্মরণ করে, এঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করাতেই এ প্রবন্ধ রচনা।
বিদ্যাসাগরের জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে আর রবীন্দ্রনাথের জন্ম ৭ মে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড়ো ছেলে বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছোটো ছেলে রবীন্দ্রনাথ। দুজনেরই পড়াশোনা কোলকাতায়, একজন সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রথাগত পাঠ নিয়ে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেছেন, অন্যজন গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রথাগত কোনো শংসাপত্র তাঁর নেই। একজন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড়ো হয়েছেন, অন্যজন বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ির আভিজাত্যে বেড়ে উঠেছেন।
শৈশবে সাধারণ ঘরের সন্তানেরা, মা-বাবার স্নেহে যেমন প্রতিপালিত হয়, রবীন্দ্রনাথ তেমন সুযোগ পাননি, চাকর-শাসিত শৈশব কেটেছে তাঁর। তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে স্নেহের অভাবের মধ্য দিয়ে।
ঈশ্বরচন্দ্রকে পিতার কড়া শাসন সইতে হয়েছে। অভাবের কারণে, রান্না-করা, বাসনমাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া- অর্থাৎ সংসারের সব কাজ করে তাঁকে করতে হয়েছে নিজের ইচ্ছামতো। বিদ্যালয়ের বন্দিদশা রবীন্দ্রনাথ সইতে পারেননি, তাই গৃহশিক্ষকদের চাপে থাকতে হয়েছে তাঁকে এবং প্রথাগত স্কুলে পড়েননি বলে, তাঁর ভবিষৎ যে ভালো হবে না, তা নিয়ে তাঁকে অনেক ব্যঙ্গ ও উপহাস সইতে হত আত্মীয়দের কাছ থেকে।
জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের সাহায্যে শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ অনুবাদ করেছিলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ, গৃহশিক্ষক রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ (ভট্টাচার্য)-এর সঙ্গে, সেই অনুবাদ নিয়ে প্রায় চল্লিশ বছরের বড়ো পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে গিয়ে, তা পাঠ করে, তাঁকে শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন যে, বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা তিনি আগে কখনো পাননি। যতদূর জানা যায়, আর একটিবার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত ‘কলিকাতা সারস্বত সম্মিলন’ -এ যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে, প্রবাদ প্রতিম বিদ্যাসাগরের সঙ্গে স্বাক্ষাৎ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের, যাঁকে সারাজীবন সুগভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসরণ করে গেছেন তিনি।
শৈশবেই বিদ্যাসাগরের রচিত বই পড়তে পড়তে, শৈশবেই পরোক্ষে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। আমরা জানি, শৈশবে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বোধোদয়’, ‘উপক্রমণিকা’, ‘ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ’ প্রভৃতি বই পড়েছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগর রচিত ‘জল পড়িতেছে। পাতা নড়িতেছে।’ পাঠ করেই ছন্দের আদিস্পন্দনের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ বাংলাসাহিত্যের নানা শাখায় পদচারণা করেছেন সফলভাবে। আর তাঁর যখন তিরিশ বছর বয়স, তখন বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয় ২৯ জুলাই ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে।
এই সময়কালের আগে থেকেই বিদ্যাসাগরের চাকরি জীবনের পাশাপাশি অপ্রতিহত গতিতে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বাঙালিজাতিকে যুক্তিবাদী মানবকল্যাণমুখী করে তোলার কাজে দৃঢ়তার সঙ্গে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। মানবসমাজ সৃষ্টির কাজে, যাঁদের যোগদান ও আত্মত্যাগ, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত, সেই নারীসমাজকে, শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে, পুরুষসমাজ কুপ্রথার ফাঁদে ফেলে গৃহবন্দি দাসী করে রেখেছিল, যা দেখে বিদ্যাসাগর যারপরনাই দুঃখে বিগলিত হয়েছিলেন এবং নারীসমাজকে উদ্ধার করা জন্য কঠিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন।
নারীশিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহের দোষ, বিধবাবিবাহ আইন প্রচলন, পুরুষের বহুবিবাহ, দাতা কর্ণের মতো দান করা, দুর্ভিক্ষে অন্নসত্র খোলা, শিক্ষাসংস্কার করা, দাতব্য চিকিৎসালায় স্থাপন-করা, কর্মাটরে বসবাস সূত্রে আদিবাসীদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ও নানাভাবে অসহায়ের সহায়তা দান-করা- প্রভৃতি কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে, বাংলা তথা ভারতের মানুষ, ‘দয়ারসাগর’, ‘করুণারসাগর’ ও ‘বিদ্যাসাগর’ বলে ডেকে শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা জানাতে শুরু করেন। সজাগ রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের এই সব মহৎ কাজকে দেখে ও শুনে প্রাণিত হয়েছেন।
উক্ত তিরিশ বছরে রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকেই ঈশ্বরচন্দ্রের ‘দয়ারসাগর’, ‘করুণারসাগর’ ও ‘বিদ্যাসাগর’ হয়ে ওঠার স্তরগুলি শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছিলেন এবং একজন কবি হয়েও মানবকল্যাণে কতোটা ব্রতী হওয়া যায়, তার আন্তরিক চেষ্টা করেছেন। দেশের মানুষের ‘হিত’ কীভাবে হবে, সারা জীবন কবিগুরু সেকথা ভেবেছেন এবং তা রূপায়ণে, পত্নী মৃণালিনী দেবীর গহনা বিক্রি করেছেন, নিজের সোনার ঘড়ি বিক্রি করেছেন, সুদে টাকা ধার নিয়েছেন, তাতেও যখন প্রয়োজন মেটেনি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য, শ্রীনিকেতনের প্রসারের জন্য, দেশ-বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে, নৃত্যনাট্য দলের সঙ্গে অভিনয় করে অর্থ সংগ্রহের প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। এসবের মূলে যে মহৎ মানুষেরা, রবীন্দ্রনাথের প্রেরণাস্থল ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের নাম সর্বাগ্রে ও স্বর্ণাক্ষরে লেখা ছিল। এখানেই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সংযোগ।
শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে, শিক্ষিত হওয়ার অধিকার থেকে, পুরুষসমাজ, নারী আর শূদ্রকে বঞ্চিত করেছিল। পুরুষসমাজ ভুলে যায়, বিদ্যাদায়িনী দেবী সরস্বতী হলেন নারী। আর সেই নারীকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করা কতো বড়ো অন্যায়। এই সর্বনাশা অবিচার থেকে নারী সমাজকে উদ্ধার করতে বিদ্যাসাগর বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন, ইংরেজ শাসকের সম্মতি নিয়ে। কিন্তু কৌলীন্য প্রথার চাপে আট বছরের কন্যার তো বিয়ে হয়ে যেত, বিদ্যালয়ে পড়া তো তাই হত না বেশিরভাগ বালিকার, তার উপর বলা হত, লেখাপড়া করলে নারী বিধবা হয় এবং নারীশিক্ষা গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ। এর বিরুদ্ধে, বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের নানাবিধ অকল্যাণকর দিক নিয়ে ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে প্রবন্ধ লেখেন ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি অনুভব করলেন, নারীশিক্ষার প্রসারের জন্য বাল্যবিবাহের প্রথা আইন করে বন্ধ-করা প্রয়োজন। বিধবার সংখ্যা কেন এতো বেশি, তারমূলেও আছে, এই বাল্যবিবাহ। বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত, তা তিনি বহু শাস্ত্র পড়ে, পরাশর সংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করে প্রমাণ করলেন।
পুরুষের বহুবিবাহ প্রথার কারণে, ভয়াবহ যন্ত্রণা সইত নারীসমাজ- এই পাহাড় প্রমাণ দুঃখ দূর করতে বহুবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত নয়, পুরুষের পশুবৎ কামবৃত্তিকে চরিতার্থ করার জন্য, এটা একটা নিন্দনীয় উপায় মাত্র, তা তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখলেন। এসব নিয়ে পরপর দুটি বই লিখলেন, বহুবিবাহের অশাস্ত্রীয় অশালীন বর্বররূপকে সমাজের কাছে মেলে ধরলেন।
পরিতাপের বিষয় হল বিধবাবিবাহ আইন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রচলনে সমর্থ হলেও বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ নিবারণ আইন প্রচলনে তিনি ব্যর্থ হন। তবে তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি, সর্বাংশে সফল না হলেও বহুলাংশ মানুষ, পরবর্তী সময়ে আলো ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজে থেকেই এই প্রথার দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে চলেছে। তাঁর নির্দেশিত পথ এখনো প্রাসঙ্গিক।
বিদ্যাসাগর বর্ণমালাকে ধ্বনিবিজ্ঞান সম্মতভাবে সাজিয়েছেন, বাল্যশিক্ষার উপযোগী ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বোধোদয়’ প্রভৃতি মূল্যবান বই লিখেছেন। বাংলাভাষাকে যারপরনাই, ভাব প্রকাশের উপযোগী করে, সববিষয়ে ধারক ও বাহক করে তুলেছেন, যা পরবর্তী বাংলাসাহিত্যে শক্তি আর সৌন্দর্যের ধারাকে অব্যাহত রেখেছে।
সাহিত্য রচনাসহ, বিদ্যাসাগরের এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন এবং পরমযত্নে তা অনুসরণের চেষ্টা করেছেন আজীবন। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণার্থে যে সভা হয়, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ নামে প্রবন্ধ পাঠ করেন (১৩ শ্রাবণ ১৩০২) এবং এর তিন বছর পরে ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ নামে আর একটি প্রবন্ধ রচনা করেন- এযাবৎ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যতো আলোচনা হয়েছে, আমাদের বিচারে এই আলোচনার দুটি সেরা। এই প্রবন্ধ দুটির ছত্রে ছত্রে নিবেদিত হয়েছে, অগ্রজ বিদ্যাসাগরের প্রতি অনুজ রবীন্দ্রনাথের বিনম্র শ্রদ্ধা। আর, বাঙালি হয়েও বিদ্যাসাগর কোন কোন গুণে, ‘অজেয় পৌরুষ’ আর ‘অক্ষয় মনুষ্যত্বের’ অধিকারী হয়ে নবজাগরণের আলো ছড়িয়েছেন, তার যথাযথ বর্ণনা রয়েছে। শুধু বক্তৃতা বা প্রবন্ধ লিখে মানবপুত্র ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেই রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্ত হননি। যে বাংলাভাষায় রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন সাহিত্য-চর্চা করেছিলেন, তার নেপথ্যে ছিল বিদ্যাসাগরের সুগঠিত, সুবিন্যস্ত, সুসংযত, ছন্দঃস্রোত যুক্ত বাংলাভাষা।
সাহিত্য-চর্চার পাশাপাশি জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রজা কল্যাণে, বিশেষকরে কৃষকদের জীবনের সামগ্রিক মানোন্নয়নে সারাজীবন বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নিয়েছেন, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষিবিদ্যা শিক্ষায় পাঠ নিতে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন, তার প্রেরণাস্থল হলেন বিদ্যাসাগর। বাংলার শিক্ষাব্যবস্থাকে পাশ্চাত্য শিক্ষার অন্ধ অনুকরণের হাত থেকে রক্ষা করতে শান্তিনিকেতনে প্রাচীন তপোবনের আদর্শে শিক্ষাদানের মহৎ চেষ্টা করেছিলেন, পরনির্ভরতার বদলে দেশের মানুষ যাতে আত্মশক্তিকে বলীয়ান হয়ে ওঠে, এই চেষ্টা, বিদ্যাসাগরের মতো রবীন্দ্রনাথও আজীবন করেছেন ।
বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ, এই দুই মহৎ মানুষ, সারাজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ - এই দুটি মানুষ, আজীবন, মানবকল্যাণে যা করা উচিত, তা করেছেন, বলতে গেলে এককভাবে। তাঁরা দেবতা নন, কিন্তু দেবতুল্য, তাঁরা ঋষি নন, কিন্তু ঋষিসম, তাঁরা আমাদের প্রাণের ঠাকুর, সমস্যা সংকুল অন্ধকার আকাশে, তাঁরাই আমাদের ধ্রুবতারা। এঁদের জানাই শত শত সভক্তি প্রণাম আর অপরিসীম কৃতজ্ঞতা।