ফেরা
ডা. প্রিয়াঙ্কা দেবনাথ
(১)
এখন পুজোর মরসুম। এসময় কিছু অবশ্যম্ভাবী ঘটনা ঘটবেই। যতই মাইকে ঘোষণা করে সাবধান করা হোক-পুজোর ভিড়ের মধ্যে ছোট ছেলেমেয়ের হাত ধরে থাকবেন, ওদের সাবধানী নজরে রাখবেন। তা সত্ত্বেও পুজো প্যান্ডেলে ছেলেমেয়ে হারানোর ঘটনা ঘটবেই। বয়স্ক মানুষরাও যে পুজোর ভিড়ে হারিয়ে যায় না, তা নয়। তবুও পুলিশের হাজারো কাজের চাপের মধ্যে এই পুজো পরিক্রমায় আর মেলায় হারানো ছেলেমেয়েকে উদ্ধার একটা উটকো ঝামেলার সৃষ্টি করে। তারপর সে এক হুলস্থুল কান্ড! অনবরত মাইকিং চলবে পুজো প্যান্ডেলে। পুলিশের তৎপরতা আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে হন্যে হয়ে ছেলেমেয়েকে খুঁজে তার বাপ মায়ের হাতে তুলে না দিয়ে স্বস্তি নেই।
মণিশঙ্কর সাইনী। এই বছর দুয়েক হয়েছে ওর পুলিশের চাকরিতে। বসুধা টাউনের নতুন কনস্টবেল হয়ে জয়েন করেছে। জয়েন করে থেকেই ওর বেশিটাই আউটডোর ডিউটি পড়ে। ওমুক বারোয়ারি পুজোর ভিড়ের সামাল দেওয়া থেকে তমুক মেলায় জনগণের ঢল তদারকি এইসব।
থানার ওসি প্রবীণ বয়সী পূর্ণজ্যোতি তপাদার। সিনিয়র থেকে জুনিয়র সবার খোলনলচে ওঁর নখদর্পণে। যেমন অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, তেমনি সবাইকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার দক্ষতা। ফলে ব্যাপারটা নজর করে ঠিক আবিষ্কার করেছেন পূর্ণজ্যোতি। ব্যাপার হলো এই- ছোট ছেলেমেয়ে থেকে বয়স্ক জন যেই মেলার ভিড়ে বা পুজোর ভিড়ের লোকসমাগমের ভেতর হারিয়ে যাক না কেন, এই মণিশঙ্কর ছেলেটি প্রচন্ড তৎপরতার সাথে তাদের খুব দ্রুত বাবা-মা বা পরিবারের কাছে পৌঁছনোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। আর প্রতিবারই তাতে একশ শতাংশ সফল হয় সে।
এক দুবার নয়। ছেলে হারানোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি এত ঘন ঘন হয় আর তাতে সববারেই মণিশঙ্করের সুনিপুণ তৎপরতায় হারানো ছেলে উদ্ধারে এত দ্রুত সমাধান হয়- আশ্চর্যের।
বসুধা টাউনের পুলিশ বিভাগের সুনামও আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে হারানো ছেলে উদ্ধারের ব্যাপারে এই তৎপরতার কারণকে কেন্দ্র করে। পুলিশ কমিশনার একদিন নিজের দপ্তরে ওসি পূর্ণজ্যোতিকে ডেকে প্রশংসাও করলেন কনস্টেবল মণিশঙ্করের এমন তৎপরতার সাথে কাজের জন্য।
(২)
পূর্ণজ্যোতি একদিন হালকা মেজাজে রয়েছেন; এমন সময় মণিশঙ্করকে নিজের চেম্বারে ডাকলেন। তারপর ছিমছাম সরল রোগাপাতলা দীর্ঘদেহী মণিশঙ্করকে একদৃষ্টে তীক্ষ্ণভাবে নিরীক্ষণের পর স্বভাবসিদ্ধ রাশভারী গলায় একটা স্নেহের ভাব এনে জানতে চাইলেন- ‘আচ্ছা মণিশঙ্কর, তুমি তোমার কর্তব্যে যেভাবে দৃঢ় প্রত্যয়ী তাতে ভবিষ্যতে অনেক উন্নতি তোমার জন্য লেখা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার একটা অন্য প্রশ্ন আছে তোমাকে।’
মণিশঙ্কর বাধ্য ছাত্রের মতো বুকের ছাতি সামনে এগিয়ে রেখে শিরদাঁড়া সোজা করে দুহাত পিছনে রেখে দাঁড়ালো। চোখের ভাষায় সম্মতিসূচক চাহনি। অর্থাৎ প্রশ্নবাণ ছোঁড়ার আহ্বানে স্বাগতম!
ওসি পূর্ণজ্যোতি তপাদার প্রশ্নটা সরাসরি রাখলেন- ‘বেশ! মণিশঙ্কর মেলার ভিড়ে বা পুজো পরিক্রমায় ছোট ছেলেমেয়ে হারিয়ে গেলে তোমার এত তৎপর হয়ে ফিল্ডে নামার পিছনে কি বিশেষ ভাবনা হয় বলোতো! এই তৎপরতার মানসিকতা আমার এত বছরের চাকরি জীবনে আমি খুব বেশি দেখিনি।’ একটু থেমে বললেন- ‘আর তুমি এতদিনে নিশ্চয়ই জেনে গেছো আমার এই কূট অনুসন্ধানী নজরের জন্য অনেকেই পিছনে আমাকে শকুন বলে বদনাম করে। তাতে অবশ্য আমার কিছু এসে যায় না।’
মণিশঙ্কর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এবার ঘাড় নেড়ে প্রশ্নের উত্তরে বলতে শুরু করলো- ‘স্যার, আমি আর আমার পিঠোপিঠি আর এক ভাই। অনেকেই বলে আমাদের দেখতে নাকি প্রায় এক। ফলে যমজ বলে ভুল হয়ে যায় কারো কারো। এমনকি স্বভাবেও আমাদের অনেক মিল। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের মিল হবে এতে আর আশ্চর্যের কি! কিন্তু আমরা অনেকটা হরিহর আত্মার মতো!
বাইরে দরজায় একটা টোকার আওয়াজ পড়তে মণিশঙ্কর থামতে যাচ্ছিলো। ওসি পূর্ণজ্যোতি গলা চড়িয়ে জানান দিলেন, ‘মুকুল, জরুরি তলব ছাড়া এখন ভেতরে কারোকে পাঠাবে না। মিটিং চলছে।’
ওসির ইশারায় মণিশঙ্কর আবার বলে চললো- ‘তখন কত আর বয়স হবে আমার, ছয় কি সাত! আর ভাইয়ের হবে পাঁচ হয়তো। আমাদের অজ গ্রামে বাড়ি আর আমাদের ন’দাদুর তখন শহরে মস্ত বাড়ি। সেখানে আমরা দুভাই মিলে সেবার মেলায় গেছি ন’দাদুর সাথে। ওই প্রথম শহরের মেলা দেখা! বাড়ির শাসন সেখানে কিছু নেই। এদিক ওদিকে ছুটোছুটি করছি আমরা। ন’দাদুর কোনো বারণ শুনছি না। রঙিন বেলুন, লাল নীল বরফ জল যা দেখছি সেদিকেই ছুটে যাচ্ছি! তারপর... তারপরই হঠাৎ সেই কালরাত্রির বিভীষিকা নামলো। ভাইকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুহূর্তে মনে হলো কে যেন আমার হাত পা মুখ বেঁধে দিয়েছে চিরকালের জন্য! সেদিন রাত্রে সত্যিই অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর ভাইকে খুঁজে পাওয়া গেল না মেলায়! ওই রাতেই কাঁপুনি দিয়ে আমার জ্বর এলো। কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। বাড়িতে ডাক্তার এলো। ওষুধ ইঞ্জেকশান সব চালু হলো। মেজো মামা পরদিন আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেল ভাইয়ের কোনো তোলা ছবি থাকলে সেসব নিয়ে আসার জন্য। আমার এদিকে কেবলই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। গলায় কোনো শব্দ নেই। কথা বন্ধ। ন’দাদু কপাল চাপড়াতে লাগল সামনে বসে। পাড়া জুড়ে সে কি হুলস্থুল... তারপর পরদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ভাই ফিরলো। এক বেলুনওয়ালার সাইকেলে চেপে। ওরও প্রায় এক অবস্থা। আমারই মতো কাঁপুনি জ্বর। অবশ্য ওর কথা বন্ধ হয় নি ভাগ্য করে; ফলে ন’দাদুর বাড়ির ঠিকানাটা বলতে না পারলেও দাদুর নাম একটু আধটু বলতে পেরেছিল! মণিশঙ্কর চোখের দৃষ্টি সহজ করার চেষ্টা করলো। ‘পরে বড় হয়েও এই ট্রমাটা বহু বছর ছিলো আমার। তাই হারিয়ে যাওয়ার বিভীষিকাময় স্মৃতিটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, যেই দেখি কোনো ছেলেমেয়ে হারিয়ে গেছে ভিড়ে। আর ততক্ষণ পর্যন্ত স্বস্তি পাই না যতক্ষণ না ওদেরকে ঠিকঠিকভাবে ওদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারি।’
ওসি পূর্ণজ্যোতি তপাদার মণিশঙ্করের কাছে এসে ওর পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বললেন- ‘বর্যাতো! বর্যাতো! ইটস ওকে মণিশঙ্কর।’ তোমার চাইল্ডহুড ট্রমাটা তোমাকে একটা ভালো কাজের তৎপরতা এনে দিয়েছে। তবে স্যার বা বড় দাদা হিসেবে আমার দুটো কথা আছে তোমার জন্য- ‘যদি মনে করো এই ট্রমাটার জন্য কখনো থেরাপির প্রয়োজন, আমাকে বোলো। আমার বন্ধু প্রখ্যাত সাইকোলজিস্ট জন্মেজয় ব্যানার্জীর সাথে একবার কনসাল্ট করে নিও। আর, আরেকটা কথা। তোমার থেকে জীবনকে একটু হলেও তো বেশি দেখেছি, তাই বলছি- বস্তু বলো, ব্যক্তি বলো কোনো কিছুতেই মাত্রাতিরিক্ত এ্যাটাচমেন্ট রাখতে নেই। ওই এ্যাটাচমেন্টটাই আমাদের শরীর মনকে দূর্বল করে। আর জীবনে সব হারানো জিনিস সবসময় ফেরানো যায় না, ফেরাতে নেই ও! লাইফ অলওয়েজ ফ্লোস ফরওয়ার্ড, ইট নেভার ফ্লোস টুওয়ার্ডস ব্যাক! ওকে বেস্ট অফ লাক এ্যান্ড টেক কেয়ার মণিশঙ্কর।’
মণিশঙ্কর ফাইলগুলো গুছিয়ে রেখে নিজের সীটে বসে ভাবতে লাগল দাপুটে, কড়া ওসি পূর্ণজ্যোতি তপাদারের ভেতরের অন্য রকম মানুষটাকে হয়তো আজ দেখতে পেলো ও। তবে ওঁর শেষের কথাগুলো ঠিকঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারলো না হয়তো মণিশঙ্কর সব ঠিকই, তবে মণিশঙ্কর এটা নিশ্চিত যে সেই উপদেশের ভেতরে পূর্ণজ্যোতি তপাদারের একশোভাগ শুভকাঙ্ক্ষাই ছিল ওর জন্য।