বৃক্ষনাথ : কমল চক্রবর্তী
রাজীব ঘাঁটী
বৃক্ষনাথ কমল চক্রবর্তী। কেন তিনি বৃক্ষনাথ?
কি তার জীবন বৃত্তান্ত? সবটা বলা বা জানা খুব সহজ কাজ নয়। তবুও চেষ্টা করছি বলার। কেননা আগামী প্রজন্ম যদি কমল চক্রবর্তী কে জানে তাহলে আমাদের সমাজ এবং গাছের গুরুত্বও তারা বুঝতে পারবে।
লেখক কবি, গায়ক সবুজ প্রেমী, মানবপ্রেমী কমল চক্রবর্তী এক বিরল ব্যক্তিত্ব। সাদা ধুতি ফতুয়া একমুখ সাদা দাড়ি উজ্জ্বল সপ্রতিভ দৃষ্টি, দেখলেই শ্রদ্ধায় নত হয়। নাগরিক খ্যাতি ও চাকচিক্যময় কর্পোরেট জীবন ছেড়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন আরণ্যক সাদামাটা সবুজ প্রকৃতির কোল। নাগরিক কোলাহল ছেড়ে মধ্য বয়সেই বেছে নেন জল-জঙ্গল-প্রকৃতির জীবন। একহাতে কলম, আর অন্য হাতে কাস্তে-নিড়ানি; পকেটে বিভিন্ন গাছের বীজ। বৃক্ষ-মানব কবি কমল চক্রবর্তী, সত্তরোর্ধ বয়সেও যিনি তারুণ্যে সজীব। প্রায় দুই দশক ধরে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘ভালোপাহাড়’ নামে দুর্গম পাহাড়ি প্রান্তরে দশ লাখ গাছের এক অরণ্য আর মুক্ত পাখির ভিন্ন জগৎ। যেখানে গভীর রাতে দুহাতে গাছ জড়িয়ে ‘হে বৃক্ষনাথ, বৃক্ষনাথ’ বলে কাঁদতেন বলে তাঁর লেখা থেকে জানতে পারি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে বুদ্ধদেব গুহ, অরুণ চক্রবর্তী বহু কবি সাহিত্যিক প্রায়শই আড্ডা জমাতেন ভালো পাহাড়ে গিয়ে। ভালো পাহাড় হল এক অনন্য সৃষ্টি, বান্দোয়ানের রুক্ষ জমিতে গাছ লাগিয়ে তিনি সবুজ ও সজীবতায় ভরে তুললেন। তরুণ বয়সে কমল চক্রবর্তী জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য না খুঁজে সুখের “ভালো পাহাড়” গড়ে তুললেন বান্দোয়ানের পিছিয়ে থাকা
পরিবারগুলোর জন্য। গাছকে ভালোবাসা মানুষের কাছে বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার। তাই তো ইনি কমল চক্রবর্তী যিনি মনে করেন এই ভুবনে প্রথম অনিবার্য বৃক্ষ এবং শেষ অনিবার্য বৃক্ষ এবং বৃক্ষহীন কোন সমাজ হয় না। এক্ষণে আমরা দেখি বৃক্ষ কে বা কি:—
ইহজগতে যা দৃশ্যত প্রাণ বা প্রাণী, বৃক্ষ ছাড়া বাঁচতে পারে না।
আমরা যে ধরনের খাদ্য গ্রহণ করি সবই বৃক্ষজাত।
আমাদের জামা কাপড় ব্যান্ডেজ তুলা, বৃক্ষ। আমাদের যাবতীয় ঔষধ যা শরীরের জন্য, বৃক্ষ।
আমাদের প্রেম ভালোবাসা ছায়া, বৃক্ষ।
আমাদের পেট্রোল, কয়লা, বৃক্ষ।
আমাদের আগুনের বোধ ও শিক্ষা বৃক্ষ।
আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস অক্সিজেন, বৃক্ষ।
আমাদের গৃহ নির্মাণের যাবতীয় খড়, বাঁশ, কাঠ পর্ণ কুটির, বৃক্ষ।
যেদিন আমাদের পৃথিবী শীতল হলো, প্রথম প্রাণ শ্যাওলা এবং ক্রমে মানুষ। যাবতীয় প্রাণীকুলের মা, রক্ষাকর্তা।
বৃক্ষকে তিনি এরকমই ভালবাসতেন এবং তিনি বলতেন আমাদের কোন বিগ্রহ বা মূর্তি নেই আমাদের দেবতা ঈশ্বর এই বৃক্ষ। যে কোন বৃক্ষ। যিনি বৃক্ষের অর্থাৎ বৃক্ষনাথের সেবা করেন তিনি আমাদের ভাই আত্মীয়।
বৃক্ষের কথা বলতে বলতে এবং বৃক্ষরোপনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি হয়েছিলেন হয়ে উঠেছিলেন আমাদের বৃক্ষনাথ। কমল চক্রবর্তী নিজেই বৃক্ষনাথ।
কমল চক্রবর্তী মত মানবের বলা ভালো মহামানবের মৃত্যু হয় না। বান্দোয়ানের দশ লক্ষ তাঁর রচিত বৃক্ষরা যুগ যুগ ধরে তাঁরই কথা বলবে। বান্দোয়ানের ভালো পাহাড় জুড়ে বৃষ্টি নামলে সেই বৃষ্টির সুরে ধ্বনিত হবে কমল চক্রবর্তী নাম। বান্দোয়ানের পিছিয়ে পড়া আদিবাসী সমাজের শিশুরা শিক্ষিত হয়ে যখন গাছেদের কথা বলবে সেখানেও কোথাও না কোথাও আমরা খুঁজে পাবো কমল চক্রবর্তীকে, আমাদের বৃক্ষনাথ কে। তাঁর অমরত্ব রচনা করবে লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ। ১৯৪৬ সালে জন্ম কমল চক্রবর্তীর, তিনি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জনিত কারণে জামশেদপুর টাটা হসপিটালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৩০ শে আগস্ট ২০২৪। ৭৮ বছর বয়সে।
তিনি চলে গেলেও তাঁর হাতে লাগানো দশ লক্ষ গাছ, বিদ্যালয়, হাসপাতাল হাজার হাজার ছাত্র, অনুগামী, সাহিত্য সম্ভার রয়ে গেল। আমরা এবং আগামী প্রজন্ম যদি এই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি তাহলে সেটাই হবে তাঁকে যথার্থ সম্মান জানানো। গাছ আমাদের সম্পদ, গাছের বিকল্প গাছই। এই ভাবনা ভেবে তার সঠিক প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন কমল চক্রবর্তী তাই তো তিনি, হ্যাঁ একমাত্র তিনিই হলেন বৃক্ষনাথ।