সালটা ১৮৯৯। আজ ১২৫ বছর হয়ে গেল। এদেশে তখন চলছে ইংরেজ শাসন। সেই বছরেরই ২৪শে মে বর্তমান আসানসোলের কাছে চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম হল এক ছেলের দুখু মিঞা। সময়ের সাথে ও প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দে কাজী ফকির আহমদ ও জাহেদা খাতুনের সেই সন্তান বড়ো হয়ে উঠলেন আর তখন সব বারুদের মতো লেখালেখি আরম্ভ করলেন যে সেগুলি পড়ে ও শুনে বঙ্গদেশের বিপ্লবীদের মনে দেশপ্রেমের আগুন আরো দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। দেশের সমস্ত তরুণকে সে সময়ের নিষ্ঠুর ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান দিয়ে রচনা করলেন রণ-সংগীত বা যুদ্ধের গান-
“চল্ চল্ চল্।
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণী-তল
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চলরে চল্
চল্ চল্ চল্॥”
‘বিজলী’ পত্রিকায় ১৯২২ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি দেশের সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীর
হয়ে অত্যাচারীদের প্রতি গর্জে উঠেছেন—
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়মকানুন শৃংখল!
আমি মানি না কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা ডুবি,
আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!”
বঙ্গ মাতার বীর সন্তানদের দমন করতে অত্যাচারী, নিষ্ঠুর শাসকগোষ্ঠী যখন তাদের কারাগারে বন্দী করল তখন কবি প্রতিবাদী হয়ে লিখলেন সেই জেল ভেঙে ফেলার গান- ‘জেল ভাঙার গান’-
“কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল পুজোর পাষাণ-বেদী!”
—এভাবেই সেই দুখু মিঞা হয়ে উঠলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলাম।
শোষক শাসকের শক্তির চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী হতে গেলে দেশের সকল মানুষকে এক হতে হবে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সমস্ত দাঙ্গা-বিভেদ দূর করে সকলের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে কবি কলম তুললেন এইভাবে—
“মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম
হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়নমণি
হিন্দু তাহার প্রাণ।”
১৯২২ সাল থেকে কবি একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন যার নাম ‘ধূমকেতু’। এতে প্রকাশিত হয় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। প্রতিবাদী নজরুল-এর এসব কান্ড দেখে সুবিধাভোগী ইংরেজ সরকারের পিলে চমকে ওঠে। ভয় পেয়ে তারা ‘ধূমকেতু’র অফিসে তল্লাশি চালায় ও কবিকে বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় হুগলি জেলে। এত কিছুর পরেও ইংরেজরা তাঁর মনোবলকে ভাঙতে পারেনি। বন্দী নজরুল ইংরেজ অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন এক অভিনব উপায়ে। জেলের মধ্যেই তিনি একমাসেরও বেশি সময় ধরে অনশন অর্থাৎ উপোস করে রইলেন। ফলে ইংরেজ সরকার বাধ্য হল বন্দী কবিকে ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মুক্ত করতে।
এবার গীতিকার নজরুলের কথা খুবই অল্প করে আলোচনা করা যাক। কম করে একখানা নজরুলগীতি না হলে বাংলাভাষী মানুষের সাংস্কৃতিক বা জাতীয় দিবসগুলি যেন ঠিক জমে ওঠে না। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সহ সকল বাঙালির কাছে নজরুলগীতি খুবই জনপ্রিয়। এত কিছুর সাথে কবির কৌতুক রসবোধও ছিল ভীষণ জোরালো। ছোটোদের জন্য লেখা ‘লিচু-চোর’, ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’, ‘খাঁদু-দাদু’ কবিতাগুলি পাঠ করলেই তা বোঝা যায়।
বিদ্রোহী কবি তথা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃতির নিয়মেই তাঁর সমস্ত অমর সৃষ্টিকে পৃথিবীর বুকে রেখে দিয়ে পার্থিব জগৎ থেকে বিদায় নেন। সালটা ১৯৭৬। আজ ৪৮ বছর হয়ে গেল।