রেইকি এক জাপানি থেরাপি

ড. উৎপল অধিকারী

রেইকি শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভের এক বিশেষ পদ্ধতি, যা প্রাচীনকাল থেকেই বৌদ্ধরা অনুসরণ করতেন। এই থেরাপি বহুকাল পূর্ব থেকেই জাপান, তিব্বত এবং চীনে প্রচলিত ছিল। রেইকি শব্দটি দুটি শব্দ্যাংশ দ্বারা তৈরী। ‘রেই’ এর মানে হলো ‘গডস উইজডম’ বা ‘ভগবানের জ্ঞান’ এবং ‘কি’ এর মানে হল-‘ভাইটাল এনার্জি’ বা ‘জীবনী শক্তি’। অর্থাৎ রেইকি শব্দটির মধ্যে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া আছে। এই থেরাপি হল ‘সার্বজনীন শক্তি’র দ্বারা নিরাময় পদ্ধতি, অথবা অনেক সময় একে ‘প্লাম হিলিং’ থেরাপিও বলে। গবেষকরা বলছেন কোন বাগানে একটি পাইপের মধ্য দিয়ে যেমন জল সিঞ্চন করলে বাগানের গাছগুলি উজ্জীবিত হয়, ঠিক তেমনিই আমাদের শরীরের মধ্যে এনার্জির একটি চ্যানেল বা শক্তির একটি লাইন আছে। রেইকি মাষ্টাররা শক্তির এই লাইনটিকে উন্মুক্ত করে দেন। ফলে আমাদের শরীরের মধ্যে ফল্গু নদীর ধারার মতো একটি শক্তিশালী শক্তিধারা প্রবাহিত হয়। আমাদের শরীর অনেক স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে, শরীরের মধ্যে নেগেটিভ এনার্জি দূর হয়, দেহ-মনে এক উৎফুল্লতা এবং প্রশান্তি বিরাজ করে। জাপানি শিক্ষা পদ্ধতি অনুসারে কোন শিক্ষক তাঁর জ্ঞানকে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সঞ্চারিত করে থাকেন, রেইকি পদ্ধতিতেও ওই গুরুকরণের মাধ্যমেই এই শিক্ষা নতুনদের মধ্যে সঞ্চারিত করা হয়।

ভাবা হয়ে থাকে, রেইকি পদ্ধতি জাপানের এক অতি প্রাচীন পদ্ধতি। কিন্তু মিকাও ঔসি বর্তমান সময়ে এই পদ্ধতিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন এবং মানুষের মধ্যে তা সঞ্চারিত করেন। তিনি তাঁর জীবনদশায় মোট দুহাজার মানুষকে এই পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন, সাল-১৯৭০। ধীরে ধীরে এই পদ্ধতি ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বহু দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি কোন ধর্ম নয় এবং কোন ধর্মচর্চাও নয়। সেই জন্য সকল ধর্মের মানুষ এই পদ্ধতির সাহায্যের তাদের নানান সমস্যা দূর করে থাকেন। পামেলা মাইলস একজন রেইকি মাস্টার। তিনি বলেন ধ্যান বা মেডিটেশন যেমন কোন ধর্মের নিজস্ব সম্পত্তি নয়, ঠিক তেমনি রেইকি একটি সার্বজনীন পদ্ধতি। বর্তমানে তাঁর উদ্যোগে নিউইয়র্কের রেইকি সেন্টার, হার্ভার্ড এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের সাথে যুক্ত  হয়ে গেছে। ফলে এই রেইকি নিয়ে মানুষের উৎসাহ এবং গবেষণার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে।

রেইকি শিক্ষার তিনটি স্তর আছে। প্রথম স্তরে-কোন ব্যক্তি হালকা স্পর্শ বা লাইট টাচ পদ্ধতিতে অভ্যাস করতে পারেন। দ্বিতীয় স্তরে-ওই ব্যক্তি দূর নিরাময় পদ্ধতি বা ডিসট‍্যান্স হিলিং ব্যবহার করেন এবং তৃতীয় স্তরে, তিনি রেইকি মাস্টার হয়ে যান ও তিনি অন্যদের শিক্ষা দিতে পারেন এবং নিজেও অভ্যাস চালিয়ে যেতে পারেন। ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রেইকি ট্রেনিং’ এর মতে রেইকি মাস্টাররা তাঁদের হাত বা তালুকে কোন রোগীর শরীরের উপর থেকে চালনা করবেন। অনেক সময় রোগীর শরীরকে নরম কাপড় দ্বারা আবৃত করা যেতে পারে। রোগীর নিজস্ব মতামত, গবেষণাপত্র ও পুরানো রেইকি বিষয়ক সাহিত্য অধ্যায়ন করে জানা গেছে, এই সময়ে রোগীর শরীরের উপর দিয়ে একটি হেলদি বা স্বাস্থ্যকর এনার্জি বা শক্তির প্রবাহ ঘটে। ২০০৮ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH) সার্ভে করে জানতে পারেন আমেরিকায় মোট ১.৫ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ও এক লক্ষ্ একষট্টি হাজার শিশুরা রেইকি থেরাপি নেন। ধীরে ধীরে এই সংখ্যা কেবলমাত্র আমেরিকায় নয়; ইংল্যান্ড’ ফ্রান্স ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতবর্ষেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রেইকি কোন রোগের ঔষধের কম্প্লিমেন্টারি বা অল্টারনেটিভ পদ্ধতি নয়। সেইজন্য বিশেষজ্ঞরা সব সময়ই বলে থাকেন: ওষুধ ত্যাগ করে কেবলমাত্র রেইকি নয়, বরং ওষুধের সাথে এবং অন্যান্য থেরাপির সাথে রেইকিকে রাখুন আপনার প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হিসাবে। তারা আরও বলে থাকেন-রেইকি কোন ম্যাজিক নয় বা কোন কালা জাদুও নয়। এটি একটি বিশেষ পদ্ধতি যা কতগুলি নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপ্লিমেন্টারি এন্ড ইন্টিগ্রেটিভ হেলথ’ এবং ‘দ্য সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটিভ মেডিসিন অ্যাট ক্লিভিল্যান্ড ক্লিনিক ইন ওয়োও’ রেইকি নিয়ে সবসময় কাজ করছে। অ্যারিজোনা কলেজ অব মেডিসিনের প্রফেসর অ্যান. এল. বলডইউন বলেছেন - মানুষের দেহের চারপাশে একটি বায়োফিল্ড বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তাকে ঘিরে রয়েছে এবং এটি প্রায় দেহ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে। ওই গবেষকের মতে রেইকি এনার্জি, এই বায়োফিল্ড এনার্জির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ফলে তার প্রভাব পড়ে শরীর এবং মনে। এই গবেষণাগারগুলির মতে আমাদের বিজ্ঞানের এখনো তেমন উন্নতি হয়নি যা এই বায়োফিল্ডকে সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারে। তাই বলে এর অস্তিত্ব নেই এটাও বলা যাবে না। কারণ হিগস-বোসন কণা যখন প্রথম কল্পনা করা হয়েছিল, তখন কোন সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছিল না, এই কণাগুলিকে চিহ্নিত করার। তাই একে ‘গডস পার্টিকেল’ বলা হত। পরবর্তীকালে তাদেরকে সার্নের গবেষণাগারে আবিষ্কার করা এবং চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল।

রেইকি থেরাপি যারা নিয়ে থাকেন; তাদের মানসিক অবসাদ, চাপ, মনের যন্ত্রণা ও শারীরিক নানান সমস্যা দূরীভূত হয়। ২০১৭ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় ‘হলিস্টিক নার্সিং প্রাক্টিস’ এই জার্নালে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা গেছে; যে সকল রোগীর হাঁটুর প্রতিস্থাপন এর অপারেশন করা হয়েছে সেই রকম ৪৬ জন রোগীকে তিনটি আলাদা-আলাদা বিভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি বিভাগের কিছু রোগীকে হসপিটালে থাকাকালীন মোট তিন থেকে চারবার ৩০ মিনিটের রেইকি ট্রিটমেন্ট করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিভাগের কিছু রোগীকে সম সংখ্যক প্লাসিবো বা সাম প্রয়োগ করা হয়েছিল এবং তৃতীয় বিভাগের রোগীদের কোনো রকম কোনো থেরাপি প্রয়োগ করা হয়নি। দেখা গেল, যে সকল রোগী কোনো ট্রিটমেন্টের মধ্যে ছিল না, সেই সকল রোগীর ব্যথা-বেদনা, রক্তচাপ, হতাশা ইত্যাদি অনেকাংশে কম ছিল নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ধরন ছিল স্বাভাবিক। এই পরীক্ষা প্রমাণ করে রেইকি থেরাপির একটি উপকারিতা আছে। রেইকি থেরাপি প্রয়োগ করে ক্যান্সার রোগীদের ব্যথা এবং মানসিক হতাশা অনেকাংশে দূর করা যায়। পশ্চিমের দেশগুলিতে অফিস এবং সারাদিনের ধকল থেকে সাময়িক কিছুটা মুক্তি লাভের জন্য অফিস ফিরতি পথে রেইকি সেন্টারগুলিতে এই থেরাপির শরণাপন্ন হয়। স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের উপর এই থেরাপির প্রভাব লক্ষ্য করা ‘হার্ভাড হেলথ’ এর মতে এই থেরাপির প্রভাবে হৃৎপিণ্ডের সংকোচন প্রসারণ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ধরন স্বাভাবিক করতে, হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে এবং দেহকে একটি ‘কাম এন্ড কোয়াইট’ কন্ডিশনে নিয়ে আসে। রাত্রে ঘুম ভালো হয়, শরীরের বিভিন্ন ধরনের হরমোন যেমন বিটা ইনডোরফিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এই হরমোনকে বলা হয়ে থাকে ন্যাচারাল পেইনকিলার হরমোন। রাত্রে এই হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে শরীরের স্বাভাবিক ব্যথা-বেদনা, যন্ত্রনা অনেকাংশে দূর হয়। কর্টিসল হরমোনের পরিমাণ হ্রাস করে। ফলে হতাশা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রি এবং পোস্ট ট্রমাটিক কন্ডিশন দূর করতে রেইকি থেরাপি ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্য আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে ট্রমা কেয়ার সেন্টারে রেইকি থেরাপি সংযুক্ত করা হয়েছে।

গবেষকদের মতে এই থেরাপির কোনরকম কোন রিস্ক বা সাইডএফেক্ট নেই। তাই দু-একটি রেইকি নেওয়ার পর এগুলিকে ছেড়ে দিলে কোন ভয়ের সম্ভাবনা নেই। তবে হ্যাঁ উপযুক্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত রেইকি মাস্টারদের কাছে এই সেশন করা যুক্তিযুক্ত। ডাউন সিনড্রোম, ক্লাইনফিল্টার সিনড্রোম, টার্নার সিনড্রোম, ক্রাই ডু চ্যাট ইত্যাদির মত ক্রোমোজোমঘটিত ডিজ অর্ডারের ক্ষেত্রে এই থেরাপির তেমন কোন ভূমিকা নেই।

লেখক- ড. উৎপল অধিকারী 

সহঃশিক্ষক, আঝাপুর হাইস্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, 

পূর্ব বর্ধমান, পিন নাম্বার-৭১৩৪০১